ফেলানি হত্যার সাত বছরেও বিচার পায়নি পরিবার

পরিতোষ পাল
2018.01.08
কলকাতা
ফেলানি হত্যা দিবস উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নাগরিক পরিষদের মানববন্ধন। ফেলানি হত্যা দিবস উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নাগরিক পরিষদের মানববন্ধন। ৭ জানুয়ারি ২০১৮।
বেনারনিউজ

বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানি খাতুনকে হত্যার অভিযোগ নিষ্পত্তি করছে না ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সাত বছর আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের সঙ্গে ঝুলে থাকা ফেলানির লাশ দুনিয়াজুড়ে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় তুলেছিল।

ওই হত্যার পর থেকে সীমান্তে হত্যার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমলেও তা বন্ধ হয়নি।

ভারত ও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো আলোচিত ফেলানি হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফেলানির পিতা নুরুল ইসলাম নুরু এবং ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) অভিযুক্তের শাস্তি এবং পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে রিট আবেদন করেছিল। এখনো পর্যন্ত সেই আবেদনের শুনানি শুরু হয়নি।

“এক অদ্ভুত অবস্থা চলছে। সবটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। দুবার দিন নির্দিষ্ট করা হলেও শেষ পর্যন্ত শুনানি হয়নি। আবার ১৮ জানুয়ারি তারিখ দেওয়া হয়েছে। জানি না সেদিনও শুনানি হবে কিনা,” বেনারকে জানান মাসুমের সহসভাপতি কিরীটী রায়।

সাত বছরেও ফেলানি হত্যার সঙ্গে জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ এবং নির্দেশদাতা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কোনো শাস্তি না হওয়ায় বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ফেলানি হত্যাকে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ওপর ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার নিকৃষ্ট উদাহরণ উল্লেখ করে ৬ জানুয়ারি বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভারতের স্থল সীমানা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশের মানুষ যতটা নির্দয়-নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়, অন্য কোনো সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। ভারতের বিএসএফের দুর্নীতি এবং বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রবল আপত্তি না জানানোয় এই পরিস্থিতির অবসান হচ্ছে না।”

তাঁর মতে, ভারতের উচ্চ পর্যায়ের বারবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। বিএসএফের বর্বরতা থেকে এ দেশের জনগণকে রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশের উচিত বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়া।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কিশোরী ফেলানিকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ফেলানির লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলতে থাকে সীমান্তের কাঁটাতারে। এই ছবি বিশ্বের মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

কিরীটী রায় বলেন, “এই হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে এখনো কোনও শাস্তি ঘোষণা করা হয়নি। বিএসএফ’র নিজস্ব আদালত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে (জিএসএফসি) ২০১৩ ও ২০১৫ সালে দুই দফায় যে প্রহসনমূলক বিচার হয়েছিল তাতে ফেলানি হত্যার সঙ্গে জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে।”

বিএসএফের সাবেক কর্মকর্তা বি ডি শর্মা বেনারকে বলেন, “ফেলানির নিহত হওয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট নির্দোষ রায় দেবার পর সমালোচনা হয়। এ​ই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার সঠিক বিচার হওয়া উচিত মনে করেই দ্বিতীয়বার বিচারের সুপারিশ করা হয়েছিল।”

তবে সেই বিচারেও অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে নির্দোষ বলা হয়। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অবশ্য জানিয়েছে, ফেলানি কোনও ভাবেই দোষী নয়। সে বিএসএফকে আক্রমণ করেনি। তাই নিরীহ কিশোরীকে হত্যা সম্পূর্ণ বেআইনি।

কিরীটী রায় বলেন, কমিশন অবশ্য নিহত কিশোরীর পরিবারকে পাঁচ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তা মানেনি।

সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন

মানবাধিকার সংগঠন মাসুম এবং নুরুল ইসলাম নুরু ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে বিচার চেয়ে রিট আবেদন করে। এই আবেদনে ভারতের বিএসএফ’র দুই দফা বিচারকে বাতিল এবং সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) বা নিরপেক্ষ কোনও তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে হত্যা তদন্তের আবেদনও জানানো হয়।

২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করে ভারত সরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বিএসএফ এবং সিবিআইকে নোটিশ জারি করে। এরপর দুই বার দিন ধার্য হলেও শুনানি হয়নি। আগামী ১৮ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে।

সীমান্তে হত্যা কমলেও বন্ধ হয়নি

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। বিএসএফ’র এক মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, বিএসএফ আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালাতে বাধ্য হয়। বিএসএফের মতে, এরা অধিকাংশই গরু পাচারকারী নয়তো চোরাচালানি।

বিএসএফের সাবেক কর্তা বিডি শর্মাও মনে করেন, “সীমান্তে হত্যা বলে কিছু হয় না। বিএসএফ আক্রান্ত হলে তবেই আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালায়।”

মাসুমের সহসভাপতি কিরীটী রায় বলেন, “ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে না। কাশ্মীর সীমান্তের চেয়েও বেশি হত্যার ঘটনা ঘটে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। অথচ এর একটিরও বিচার হয় না।”

তিনি আরও বলেন, “বিএসএফের গুলিতে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ভারতেরও বহু নাগরিক প্রতিবছর নিহত হচ্ছে।”

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর মতে, “শিশু থেকে শুরু করে যে কোনও বয়সের বাংলাদেশি নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা-নির্যাতন বিএসএফএর কাছে নতুন নয়।”

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফ ৪০৩ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে ২৬৯ জনকে গুলিতে, ১০৯ জনকে নির্যাতন করে এবং ২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫৯৩ জন বাংলাদেশি বিএসএফ সদস্যদের হাতে আহত হয়েছেন। এসব আহতের মধ্যে ৩৩৭ জন বিএসএফ’র গুলিতে, ২১৯ জন নির্যাতনে এবং ৩৭ জন অন্যান্যভাবে আহত হয়েছেন।

এই সময়ে বিএসএফ ৪৬৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সীমান্ত হত্যা তুলনামূলক কমেছে। ২০০৯ সালে সীমান্তে মারা যায় ৬৭ জন। পর্যায়ক্রমে কমে এটা ২০১৬ সালে হয়েছে ৩১ জন। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মারা যায় ২১ জন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।