অনিশ্চিত তিস্তা চুক্তি, প্রধানমন্ত্রী ভারত যাবেন এপ্রিলে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2017.02.23
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ড. সুব্রানিয়াম জয়শঙ্কর। ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

দুই দফা পেছানোর পর আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর। বাংলাদেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুব্রানিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর এ সময়সূচি ঠিক করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব এম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “এপ্রিলের প্রথমার্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সফরে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।”

এ সফরে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বিষয়ে সমাধানের আশায় রয়েছে বাংলাদেশ।

তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এবারও বহু প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তির বিষয়ে সমাধান আসছে না। তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দপ্তর থেকেও বেনারকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে কেন্দ্র করে দু’দেশের মধ্যে ইতিমধ্যে কয়েক ডজন চুক্তির খসড়া বিনিময় হয়েছে। এসবের মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ কোনোটিই নেই বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বেনারকে নিশ্চিত করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে কোনো সমাধান না আসা হতাশার ব্যাপার হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারতকে একের পর এক সুবিধা দিলেও দেশটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা ভাবা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে যদি কোনো ইতিবাচক ফলাফল না আসে, তাহলে সেটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য খুবই হতাশার ব্যাপার হবে।”

তাঁর মতে, “গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে, বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে ভারত সেরকম পদক্ষেপ নিচ্ছে না।”

তারপরেও প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কূটনীতিকেরা।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সফর হবে এপ্রিলে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস। তাই আগেই হতাশ হওয়া ঠিক হবে না। এ সফরে ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পারস্পরিক লাভের ভিত্তিতেই আরও জোরদার করা হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

এর আগে ২০১৫ সালে প্রথম বাংলাদেশ সফরের এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে দ্বিপক্ষীয় সফরের আমন্ত্রণ জানান। গত বছরের ডিসেম্বরে সে সফর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি স্থগিত হয়। পরে চলতি ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যাওয়ার কথা বলা হয়। দ্বিপক্ষীয় সফর না হলেও গত অক্টোবরে ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দিতে মোদির আমন্ত্রণে গোয়া গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দু’দিনের সফরে ঢাকা পৌঁছান ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন তিনি।

প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল ইসলাম ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে উপ প্রেসসচিব নজরুল ইসলাম জানান, “জয়শঙ্কর বলেছেন শেখ হাসিনার এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। এই সফরে প্রধানত: পারস্পরিক স্বার্থ এবং ধাপে ধাপে উন্নয়ন উদ্যোগের পাশাপাশি যোগাযোগ সংযুক্তির বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে।”

উপ প্রেস সচিব বলেন, “ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশের উন্নয়নের দিকে লক্ষ রেখে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে জোর দেওয়া​র ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের চাহিদার ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে।”

বৈঠকে স্থল সীমানা এবং ছিটমহল সমস্যা সমাধান হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সদিচ্ছা থাকলে সব সমস্যার সমাধানই সম্ভব।”

শেখ হাসিনা কানেকটিভিটি এবং উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন বলেও জানান নজরুল ইসলাম।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এবার ভারত সফরে শেখ হাসিনা দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকবেন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে।

তিস্তার বাধা মমতা, আপত্তি গঙ্গা ব্যারেজেও

শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু মমতা ঢাকায় না আসায় চুক্তিটি সই হয়নি। ২০১৫ সালে মোদির সফরসঙ্গী হলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘদিন পরেও সেই একই অবস্থানে অটল রয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ পরিবহন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী নিজে দেখছেন। তিনিই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।”

তবে বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানতে চায়নি বলেও জানান তিনি।

এদিকে তিস্তার বিষয়ে নিরাশা থাকলেও গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ নিয়ে আশা দেখছিল বাংলাদেশ। এ ব্যারাজ নির্মাণ হলে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা ভাঙনের কবলে পড়বে এমন অজুহাত তুলে তাতেও বেঁকে বসেছেন মমতা। এমনকি এ বিষয়ে দু’দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কারিগরি কমিটি থেকে রাজ্যের প্রতিনিধিকেও প্রত্যাহার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

এ বিষয়ে ড. আকমল বলেন, “তিস্তা নিয়ে যে চুক্তি হবে না, তার আলামত দেখতে পাচ্ছি। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র মনোমালিন্য চলছে। গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ নিয়েও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আগ্রহী ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতেও আপত্তি তুলেছেন।”

তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের স্বার্থ নিয়েই ভাবছেন, আমাদের স্বার্থের প্রতি তারা কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আমাদের সরকারও এ বিষয়ে ভারতের ওপর বিশেষ কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।