নির্দোষ হলেও বাদলের মুক্তিতে অনেক বাধা, ঢাকায় রিট খারিজ

জেসমিন পাপড়ি
2018.07.11
ঢাকা
180202_Chief_Justice_620.jpg বাংলাদেশ হাই কোর্ট ভবন। ফাইল ছবি।
নিউজরুম ফটো

হত্যা মামলায় ১০ বছর ভারতে কারা ভোগের পর দেশে ফিরিয়ে আনা বাদল ফরাজীর কারামুক্তির নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদন খারিজ করেছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত। তাঁর মুক্তির বিষয়ে সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে—এমন মত দিয়ে হাই কোর্ট বলেছে, সরকারের প্রতি বাদল ফরাজীর মুক্তির বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা দেওয়া সমীচীন হবে না।

বুধবার ‘উত্থাপিত হয়নি মর্মে’ রিট আবেদন খারিজ করে এই আদেশ দেয় বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

আদালতের বাইরে নির্দোষ বলে পরিচিতি পাওয়া এই আসামির রিট খারিজের আদেশে আদালত বলেছে, “ভারতের আদালতের রায়ে দেখা যাচ্ছে, সে দেশের একটি হত্যা মামলায় বাংলাদেশের বাদল ফরাজীকে সাজা দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ সরকার তাঁর (বাদল ফরাজী) বিষয়ে ইতিবাচক। সরকার পদক্ষেপ নিয়ে বাদল ফরাজীকে এ দেশে নিয়ে এসেছে।”

“এখন তাঁর ব্যাপারে সরকারই হয়তো পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ নেবে। তাই রিটটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করা হলো,” জানায় আদালত।

এর আগে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় গত ৬ জুলাই বাদল ফরাজীকে দেশে ফেরত আনা হয়। সেদিন বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষে তাঁকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

ভারতে একটি হত্যা মামলায় নাম-বিভ্রাটের কারণে ‘নিরপরাধ’ বাদল ফরাজীর সাজা হয়েছে বলে উল্লেখ করে তাঁর কারামুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত রোববার উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হ‌ুমায়ূন কবির পল্লব ও মোহাম্মদ কাওছার।

রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব বেনারকে বলেন, “বাদল ফরাজীর কারামুক্তির নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনটি উচ্চ আদালতে খারিজ হওয়ার ফলে তাঁর মুক্তিতে সামনে আর কোনো আইনি প্রক্রিয়া খোলা নেই। একমাত্র সাজা মওকুফ চেয়ে করা আবেদনের মাধ্যমেই বাদলের কারামুক্তি মিলতে পারে।”

এক প্রশ্নের জবাবে ওই আইনজীবী বলেন, বাদল ফরাজী মুক্তির জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজা মওকুফের আবেদন করতে পারেন। অথবা ভারতীয় সংবিধানের ১৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজা মওকুফের জন্য ভারত সরকারের কাছেও আবেদন করার সুযোগ আছে।

এ অবস্থায় ‘নিরপরাধ’ বাদলের মুক্তির জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি সামনে এনেছেন অনেকেই। যদিও বিদেশের আদালত তাঁকে সাজা দেওয়ায় সেটা কার্যকর হবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে বাদলের মুক্তির জন্য বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে পারে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিদেশের আদালত তাঁকে (বাদল ফরাজী) শাস্তি দিয়েছেন। বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় তাঁকে ফেরত আনা হয়েছে। এ সমস্ত বিষয়গুলো বিচার বিশ্লেষণ করে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা রিভিউ পিটিশন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে ফাইল করা ‍উচিত। ফর রিভিউ দ্য এনটায়ার জাজমেন্ট।”

“বলতে হবে, একটা ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটা লোক ১০ বছর সাজা খেটেছে। বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় সে দেশে ফিরেছে। এখন রিভিউয়ে যদি প্রমাণিত হয় সে অপরাধী না, তাহলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া যায়,” পরামর্শ সাবেক আইনমন্ত্রীর।

এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাসুদ হাসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বাদল ফরাজী বাংলাদেশের নাগরিক এবং ওই অপরাধে জড়িত—এ বিষয়টি বিচার্য রেখেই হত্যা মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ভারতের আদালত।”

“বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বাকি সাজা এ দেশের কারাগারে ভোগ করার জন্য বাদলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরপর কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সে বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে,” বলেন তিনি।

বাদল ফরাজী। ফাইল ছবি।
বাদল ফরাজী। ফাইল ছবি।
নিউজরুম ফটো
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বৈধভাবে ভারত যাওয়ার পথে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের পরই বাগেরহাটের বাদল ফরাজীকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী–বিএসএফ।

সে বছরের মে মাসে তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধাকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ওই অপরাধে ভারতীয় নাগরিক বাদল সিংহের বদলে বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মূল হত্যাকারী বাদল সিংহের নামের সাথে মিল থাকায় শাস্তি পেতে হয় বাংলাদেশের এই যুবককে।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাদল ফরাজী নিরাপরাধ কিনা সেটি দেখার সুযোগ এখন বাংলাদেশের আদালতের নেই। কেননা, তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে একজন দোষী ব্যক্তি হিসেবে, যিনি সাজা খাটছেন। তাঁকে বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় দেশে ফিরিয়ে এনে বাকি কারাদণ্ড দেশে ভোগ করার কথা।”

“সে নিরপরাধ কিনা এই প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ ছিল ভারতীয় আদালতে । এই প্রশ্ন বাংলাদেশের আদালতে উত্থাপনের সুযোগ আর নেই,” বলেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি বাদল ফরাজীকে ক্ষমা করতে পারেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মিজান বলেন, “সাংবিধানিক ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে যে কোনো অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ভারতের আদালত শাস্তি দিয়েছে বলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না, এমন বিধিনিষেধ নেই। সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ আরোপ হতে পারে না।”

“তবে তাঁর (রাষ্ট্রপতি) এ ক্ষমতা যত্রতত্র ব্যবহার করার কথা নয়। কারণ, রাষ্ট্রপতি যখন এ সিদ্ধান্ত নেবেন, আমাদের ধরে নিতে হবে সেটি একটি সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের এই অধ্যাপক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।