সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতে মুসলিমদের ঈদ উদযাপন

ঝুমুর দেব
2017.06.26
গৌহাটি, ভারত
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদে ঈদের দিনে মুসলিমদের কালো ব্যাজ ধারণ। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদে ঈদের দিনে মুসলিমদের কালো ব্যাজ ধারণ। বিজনর, উত্তর প্রদেশ, ২৬ জুন ২৯১৭।
সৌজন্যে: ফাসি-উর রহমান

আপডেটঃ ২৭ জুন ২০১৭, ইস্টার্ন টাইম সকাল ১০.৩

তিন বছর আগে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রতিবাদে হাতে কালো ব্যাজ পরে সোমবার ঈদ উদযাপন করেছেন ভারতের মুসলমানেরা।

এদিকে বৃহস্পতিবার পৃথক দুটি ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ ও হরিয়ানায় স্বঘোষিত গোরক্ষকদের আক্রমণে নিহত হয়েছেন চারজন।

হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যগুলোতে গরুকে দেবতা মান্য করে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ।

“ঈদের দিন কেন কালো ব্যাজ পরছেন?”

নয়াদিল্লির বাসিন্দা দৌলত খানকে বেনারের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন, “আমরা দুর্ভোগের একেবারে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছি। আমরা ঈদের দিনে সরকারকে এই কথাটা বলতে চাই যে, আমাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত সহিংসতার কারণে ঈদের দিনও আমাদের পক্ষে খুশি থাকা সম্ভব হচ্ছে না।”

‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়’

গত বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলায় গরু চুরির অপরাধে গণপিটুনিতে নিহত হন তিনজন। এরা হলেন নাসিরুল হক (৩০), মোহাম্মদ সামিরউদ্দীন (৩২) ও মোহাম্মদ নাসির (৩৩)।

এই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।

প্রসঙ্গত ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর এই ধরনের আক্রমণের সর্বশেষ ঘটনা এটি।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা পঙ্কজ ঝা বেনারকে বলেন, “তিন সন্দেহভাজন, অসিত বসু, অসীম বসু ও কৃষ্ণ পোদ্দারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজে জোর তল্লাশি অভিযান চলছে।”

“যে তিন যুবক নিহত হয়েছেন তারা সকলেই চোর বলে পরিচিতি। এদের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ রয়েছে,” বেনারকে জানান উত্তর দিনাজপুরের সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (এসপি) অমিত কুমার ভরত রাঠোড়।

তবে এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে মানতে রাজি নয় রাজ্য সরকার।

এ প্রসঙ্গে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক হামিদুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “এটা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক বিরোধের ঘটনা নয়।”

“বৃহষ্পতিবার রাতে তিনজন চোরকে গ্রামবাসীরা ধরে ফেলে। এই সময়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভ হিংসার রূপ নেয়,” বলেন হামিদুর রহমান।

‘তার চিৎকার কানে ভাসে’

এদিকে পৃথক একটি ঘটনায় বৃহস্পতিবার ‘গরু খাদক’ ও ‘রাষ্ট্র বিরোধী’ আখ্যায়িত করে চলন্ত ট্রেনে মুসলিম চার ভাইয়ের ওপর ছোরা দিয়ে আক্রমণ চালায় উত্তেজিত জনতা।

চলন্ত ট্রেনে দুই ঘণ্টা ধরে চলা ওই সহিসংতায় চার ভাইয়ের একজন, হাফিজ জুনায়েদ (১৬) নিহত হন। পুলিশ জানায় আক্রান্ত চার ভাই নয়াদিল্লিতে ঈদের কেনাকাটা শেষে ট্রেনে করে উত্তর প্রদেশের মথুরা ফিরছিলেন।

ওই ঘটনায় ছুরিকাহত জুনায়েদের বড়ো ভাই হাশিম (২০) হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, “এটা কোনোভাবেই ভোলা সম্ভব না যে রক্তাক্ত জুনায়েদ আমার কোলের ওপর শুয়ে আছে। এখনো তার চিৎকার আমার কানে ভাসছে। প্রতিটা আঘাতেই সে আরো জোরে জোরে চিৎকার করছিল।”

এই ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কোনো পরিচয় প্রকাশ করেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে সে আমাদের জানিয়েছে যে, মুসলমান ভাইয়েরা গরু খেয়েছে বলে তার বন্ধুরা তাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য তাকে উসকানি দিয়েছিল।”

‘লজ্জাজনক’

ক্ষমতাসীন বিজেপির তিন বছরে গরু চুরি অথবা গরু খাওয়ার অভিযোগে এই রকম দুই ডজনের বেশি গণ-আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, যাতে কমপক্ষে ১০ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জন মুসলিম।

এই ধরনের সহিংসতার প্রতিবাদে গত সপ্তায় টুইটার ও ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে #StopKillingMuslims ও #EidWithBlackArmBand এর মতো হ্যাশট্যাগ প্রচারণা চালানো হয়।

এদিকে স্বঘোষিত গোরক্ষকদের দ্বারা নিয়মিত সহিংসতার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার জন্য বিজেপিকেই দোষ দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

“বিজেপির আদর্শবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতকে একটি সম্পূর্ণ হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা। গরু সুরক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার এই পরিকল্পনারই অংশ,” বেনারকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লষক প্রদীপ ভট্টাচার্য।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর মিনাক্ষী গাঙ্গুলি তাঁর এক কালামে লেখেন, “মুসলমানদের ওপর গরু সংক্রান্ত সহিংসতার ক্ষেত্রে বিজেপি নেতাদের মৌনতা এই বার্তাই দেয় যে, এইসব সহিংসতায় বিজেপির সমর্থন রয়েছে।”

“সবাইকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর, এখন মনে হচ্ছে সরকার দুর্বলদের রক্ষার বিষয়ে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক,” বলেন গাঙ্গুলি।

এ বিষয়ে বেনারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করেও কোনো শীর্ষ বিজেপি নেতার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে বিজেপির আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঘটনাটিকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

“এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। সরকার কোনোভাবেই এই রকম আক্রমণের ঘটনা বরদাশত করবে না,” এনডিটিভিকে বলেন রবিশঙ্কর প্রসাদ।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।