ত্রিপুরায় মুসলিমদের ওপর আক্রমণ, সব মসজিদের নিরাপত্তা জোরদার

পরিতোষ পাল
2021.10.29
কলকাতা
ত্রিপুরায় মুসলিমদের ওপর আক্রমণ, সব মসজিদের নিরাপত্তা জোরদার ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদে নয়া দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদ সভা থেকে একজনকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছেন নিরাপত্তা কর্মীরা। ২৯ অক্টোবর ২০২১।
[এএফপি]

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা থেমে গেলেও এর প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গত কয়েকদিন ধরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত বুধবার সীমান্তবর্তী পানিসাগর এলাকায় সহিংস ঘটনার পর রাজ্যের ১৫০টি মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ।

“মুসলিমরা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন,” শুক্রবার বেনারকে বলেন আকিল আহমদ নামে পানিসাগরের এক স্থানীয় যুবক। 

পুলিশ ও সংখ্যালঘু নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, গত দশ দিনে ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশে কমপক্ষে ১০টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। সব ক্ষেত্রেই মসজিদ এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে।

বুধবারের সহিংস ঘটনার পর উপদ্রুত এলাকায় জমায়েতের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী।

এসব ঘটনা ঠেকাতে না পারায় কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারের কঠোর সমালোচনা করছে বিরোধীরা। যদিও রাজ্য সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। 

উত্তর ও পশ্চিম ত্রিপুরা এবং গোমতী, শিপাহিজলা ও উনকোটিতে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ও মসজিদে আগুন দেবার ঘটনা প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি সুস্মিতা দেব শুক্রবার বেনারকে বলেন, “সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য নিয়েই সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও তাদের ধর্মীয় স্থানে আগুন লাগানো হচ্ছে।”

এই হিংসায় যারা মদত দিচ্ছে সেসব দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান শ্রীমতী দেব। 

তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শুক্রবার ত্রিপুরার রাজ্যপাল সত্যেন্দ্রদেও নারায়ণ আরিয়াকে লেখা এক চিঠিতে সুস্মিতা দেব রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার সংকটজনক পরিস্থিতি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

বাংলাদেশে সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান ও পূজা মণ্ডপে হামলার পাল্টা হিসেবে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে। হিন্দুবাদী সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ মিছিলের পর পরই এসব ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়। 

তবে ত্রিপুরা পুলিশের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে একদল মানুষ গুজব ছড়াচ্ছে এবং উত্তেজনাকর বার্তা প্রচার করছে। 

বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনও এমন বিবৃতি দিয়ে বৃহস্পতিবার জানায়, কতিপয় ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে ত্রিপুরা পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছে। 

তবে মুসলিমদের সংগঠন জমিয়ত উলেমার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত ১৯ অক্টোবর থেকেই একদল মানুষ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিকভাবে মুসলিমদের ধর্মীয় স্থান এবং দোকান, বাড়িঘরে আক্রমণ করছে। 

গত ২২ অক্টোবরই জমিয়তের প্রেসিডেন্ট মুফতি তায়েবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর ও পুলিশ সুপারকে মুসলিমদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে স্মারকলিপি দেন। 

পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও ত্রিপুরা পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভি এস যাদবের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করছে। 

পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভি এস যাদব সাংবাদিকদের জানান, রাজ্যের ১৫০টি মসজিদে প্রহরা দেওয়া হচ্ছে। সব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আসামিদের চিহ্নিত করা হবে। 

তবে পুলিশের আশ্বাস সত্ত্বেও হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ মিছিলের পর পরই মুসলিমদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। 

এদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়, পানিসাগরের পুলিশ আধিকারিক সৌভিক দে বলেছেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ চামটিলায় একটি মসজিদে ভাঙচুর চালায়। পরে কাছেই রোয়া বাজার এলাকায় মুসলিমদের তিনটি বাড়ি ও তিনটি দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। 

এর আগে গোমতীর উদয়পুর মহকুমার মহারাণিপুরে একটি মসজিদে আগুন দেওয়া হয়। আগরতলার কৃষ্ণনগরের একটি মসজিদে আক্রমণ করা হয়। উনকোটির পালবাজার অঞ্চলে এক মুসলিম আইনজীবী ও কৈলাশহরে এক মুসলিম ব্যবসায়ীর ওপরও আক্রমণ করা হয়। 

tripura2.jpg
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূরে রাওয়া নামের একটি গ্রামে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় পুড়িয়ে দেয়া একটি দোকানের সামনে টহল দিচ্ছেন ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর এক সদস্য। ২৭ অক্টোবর ২০২১। [এপি]

রাজনৈতিক দোষারোপ

এদিকে “বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরঙ দলের মাধ্যমে ভারতীয় জনতা পার্টি এসব হিংসাত্মক ঘটনা পরিচালনা করছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সদস্য পবিত্র কর। 

তিনি বলেন, “ত্রিপুরার ইতিপূর্বে সাম্প্রদায়িক হানাহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং শান্তিপূর্ণ রাজ্য হিসেবেই থেকেছে সব সময়।”

“তাই এবারের হামলার ঘটনার আমরা তীব্র প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব এখন পর্যন্ত মুসলিমদের উপর হামলা নিয়ে শক্ত অবস্থান নেননি।” 

ত্রিপুরা বিজেপির নেতা ও এমপি বিনোদ সোনকার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, “ত্রিপুরার সাম্প্রতিক হিংসার ঘটনা নিয়ে দলের সংখ্যালঘু সেলের ৫ সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে কেন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটল, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।” 

ত্রিপুরার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতিও শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতা সোনকার বলেন, “এই সব ঘটনার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস জড়িত। তারাই ত্রিপুরায় জায়গা পেতে এসব করছে।” 

তবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সুস্মিতা দেব বলেন, “আগামী নভেম্বরে ত্রিপুরায় পুরসভা নির্বাচন রয়েছে। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের মেরুকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হিংসাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।” 

একই অভিযোগ করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে পবিত্র কর বলেন, “নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে ভারতীয় জনতা পার্টি হিন্দু সংগঠনগুলির মাধ্যমে হিন্দু ভোট সংহত করতে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে।” 

ত্রিপুরা ইস্যুতে বিজেপি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন রাহুল গান্ধী। বৃহস্পতিবার তিনি অভিযোগ করেন, ত্রিপুরায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। রাহুলের প্রশ্ন-সরকার কতদিন অন্ধ ও বধির হওয়ার ভান করে থাকবে। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মের নামে যারা সহিংসতা করে তারা হিন্দু নয়, ভণ্ড।

ত্রিপুরার তিন দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। আর একদিকে ছোট্ট একটি অংশ যুক্ত আসামের সঙ্গে। রাজ্যের মোট ৪২ লাখ জনসংখ্যার ৯ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম। বাকি জনসংখ্যার অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তু।

২০১৮ সালে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারকে হটিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি ত্রিপুরার ক্ষমতায় আসে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।