ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ স্থগিত করল সুপ্রিম কোর্ট
2022.05.11
কলকাতা

ঔপনিবেশিক আমলের বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগে স্থগিতাদেশ দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বুধবার আদালতে এই আইন ভারত সরকারের পর্যালোচনার সিদ্ধান্তের কথা জানানোর পর আদালত ওই অন্তর্বর্তী আদেশ দেয়।
১৫২ বছরে এই প্রথম আইনটির ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ দেওয়া হলো।
মামলার আইনজীবীরা জানান, আদেশে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা এবং বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি হিমা কোহলির সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের পর্যালোচনা প্রক্রিয়া শেষ না করা পর্যন্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় কোনো মামলা রুজু, তদন্ত কোনোকিছুই করা যাবে না।
একই সাথে বর্তমানে যারা রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন তাঁরা জামিনের আবেদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন বিচারকেরা।
বর্তমানে প্রায় ৩০০০ মানুষকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আটক রাখা হয়েছে বলে শুনানির সময় আদালতে জানান আইনজীবী কপিল সিব্বাল।
আগামী জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করা হয়েছে।
ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন এবং সাংবাদিকেরা অনেক দিন ধরেই রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আসছে।
মামলার অন্যতম আবেদনকারী এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া এদিন টুইট করে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
জাতীয় কংগ্রেসের সাবেক প্রধান রাহুল গান্ধী টু্ইট করে বলেন, সত্যি কথা বলাই দেশপ্রেম, রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। সত্যি কথা শোনা রাজধর্ম সত্যকে ধ্বংস করা হল ঔদ্ধত্য।
তবে আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজেজু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “সরকার যাতে আদালতকে সম্মান করে সেজন্য আদালতেরও উচিত সরকার, আইনসভাকে সম্মান করা। আমাদের স্পষ্ট সীমারেখা রয়েছে। সেটা অতিক্রম করা কারও উচিত নয়।”
ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র নলিন কোহলি সাংবাদিকদের বলেন, মোদী সরকার ইতিমধ্যে ঔপনিবেশিক আমলের ১৫০০ পুরনো আইন বাতিল করেছে। এ আইনের ক্ষেত্রেও পর্যালোচনা করার যে প্রস্তাবের কথা সরকার আদালতে জানিয়েছে, তার আলোকে আদালত সবটি বিবেচনা করবে।
বেপরোয়াভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগের অভিযোগ
মানবাধিকার ও সমাজকর্মীদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে সরকার বিরুদ্ধ মতের মানুষ এমনকি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও বেপরোয়াভাবে এই রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করেছে।
“প্রশাসন যে কোনো অজুহাতে ওয়ারেন্ট ছাড়াই জামিন অযোগ্য এই ধারায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করছে। বিনা বিচারে আটকে রাখছে। বিশিষ্ট সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতো মানুষকেও এই আইনে আটকে রাখা হয়। কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর মৃত্যুও হয়,” বেনারকে বলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী কিরীটি রায়।
তিনি বলেন, “ঔপনিবেশিক আমলে এই আইনটি তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে বারবার। বাল গঙ্গাধর তিলক ও মহাত্মা গান্ধীর মত ব্যক্তিদের এই আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আর এখন সরকার ভিন্ন মতের সকলকে এই আইনে অভিযুক্ত করছে।”
ভারতের শীর্ষ আদালতে সাংবাদিক কিশোরচাঁদ ওয়াংখেমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন একগুচ্ছ রিট পিটিশনে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সাবেক সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এস জি ভোম্বাটকারে, সাবেক মন্ত্রী অরুণ শৌরি, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র, এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া,জার্নালিস্ট ইউনিয়ন অব আসাম, পিইউসিএল, সাংবাদিক প্যাট্রিসিয়া মুখিম, অনুরাধা ভাসিন, অনিল চামাদিয়া সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে এই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করার পাশাপাশি এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রামানা গত বছরই এই আইনকে ঔপনিবেশিক আইন হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, আইনটি স্বাধীনতাকে দমন করে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও এই আইন আবশ্যক কিনা তিনি সেই প্রশ্নও তুলেছেন।
তবে এদিনের সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে “কোনো সিদ্ধান্ত নয়” জানিয়ে সাবেক বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত বেনারকে বলেন, “আদালত এমন একটি বিষয়ে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন স্তরের মানুষ আইনটি পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছেন। তাই সরকারকে রাজ্যসরকারসহ সবপক্ষের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত আইনটি বর্তমানে যে আকারে রয়েছে তা থাকা উচিত নয়। তাই এর পরিবর্তন প্রয়োজন।”
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে “ঐতিহাসিক নির্দেশ” নির্দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় সাংবাদিকদের বলেন, “তবে এই আইনটি বাতিলের নির্দেশ দিলে ভালো হতো।”
বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন
১৮৬০ সালে যখন ভারতীয় দণ্ডবিধি চালু করা হয়, তখন রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি তাতে ছিল না। পরে ১৮৭০ সালে বিরোধী মতকে স্তব্ধ করতে সংশোধন করে দণ্ডবিধিতে ১২৪এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। আর ১৯৭৩ সালে বিনা ওয়ারেন্টে জামিন অযোগ্য ধারায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১৮ সালে অবশ্য ভারতের আইন কমিশন উল্লেখ করে, ভারতের সংবিধান তৈরির সময় প্রণেতারা সংবিধানে রাষ্ট্রদ্রোহ কথাটি রাখতে চাননি।
কমিশনের মতে, জনগণকে তাদের মতো করে দেশকে ভালোবাসার স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। এটা করতে গিয়ে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা যত কঠোর হোক না কেন তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
তবে কমিশন সুপারিশ করে একমাত্র হিংসাত্মক ও অবৈধ উপায়ে সরকারকে উচ্ছেদ এবং আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার মামলায় এই আইন প্রয়োগ করা হোক। কমিশনের মতে, ১২৪এ ধারা থাকা উচিত। তবে রাষ্ট্রদ্রোহ কথাটির বিকল্প ভাবা দরকার।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিশ্বজিৎ মুখার্জি বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্রদ্রোহের ক্ষেত্রে কী মাপকাঠি হওয়া দরকার তা বারবার সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলায় বলেছেন। কিন্তু দেখা গেছে, শাসক দল বাক স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে ভিন্ন মতের মানুষকে এই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে গ্রেপ্তার করছে।”
“বর্তমান সরকারের আমলে নির্বিচারে এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি থেকে সাংবাদিকরা পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছেন।”
তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, “ভারত সরকার প্রথমে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের পক্ষে আদালতে সওয়াল করলেও শেষ পর্যন্ত আদালতের মনোভাবের প্রেক্ষিতে আইন পর্যালোচনার কথা আদালতকে জানান।”