ভারতের মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা: সেনা মোতায়েন, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন, কারফিউ

পরিতোষ পাল
2023.05.05
কলকাতা
ভারতের মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা: সেনা মোতায়েন, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন, কারফিউ তফশিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দাবিতে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাসের নিক্ষেপ করছেন নিরাপত্তাকর্মীরা। ৪ মে ২০২৩।
[এএফপি]

সংখ্যালঘু আদিবাসী ও সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতার জেরে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্য মণিপুরে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইন্টারনেট, জারি হয়েছে কারফিউ।

গত বুধবার শুরু হওয়া সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে বৃহস্পতিবার রাজ্যের ১০ জেলায় সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি শুক্রবারও আসাম ও নাগাল্যান্ড থেকে রাজ্যটিতে অতিরিক্ত সেনা পাঠানো হয়েছে।

মণিপুরে বুধ ও বৃহস্পতিবার জাতিগত সংঘর্ষে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে স্থানীয় দ্য অয়ার এবং সানগাই এক্সপ্রেস। তবে সরকারিভাবে মৃতের এই সংখ্যা নিশ্চিত করা হয়নি।

কারফিউ জারির কথা জানিয়ে মণিপুরের পানি সম্পদ মন্ত্রী আওয়াঙবো নিউমাই সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, পরিস্থিতি থমথমে থাকলেও তা এখন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।

সংঘর্ষে মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি তিনি।

উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তবর্তী এই রাজ্যটির ১০টি জেলায় রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশে বৃহস্পতিবার থেকে পাঁচ দিনের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে মণিপুরের রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকে চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে দেখামাত্র গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেন।

প্রতিরক্ষা বিভাগের জনসংযোগ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম রাওয়াত শুক্রবার গণমাধ্যমকে জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তবে চূড়াচাঁদপুরসহ স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে ফ্ল্যাগ মার্চ চলছে।

প্রায় ১১ হাজার মানুষকে উপদ্রুত এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

‘ভুল বোঝাবুঝি’র কারণে সহিংসতা: মুখ্যমন্ত্রী

উপত্যকার হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়কে তফশিলি উপজাতির স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ের খ্রিস্টান আদিবাসীরা ১০ জেলায় প্রতিবাদ জানান। এরপর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে তা সহিংসতায় রূপ নেয়।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, বুধবার ও বৃহস্পতিবার ধারাবাহিক সংঘর্ষে ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবারও উপত্যকার সীমানা লাগোয়া এলাকায় আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে।

শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় ভারতীয় জনতা পার্টি শাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং মণিপুরের জনগণের কাছে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে বলেন, “সমাজের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণেই সহিংস ঘটনা ঘটেছে।”

পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় অতিরিক্ত আধাসামরিক বাহিনী আনা হচ্ছে।”

সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, মণিপুরের গোষ্ঠী সংঘর্ষ মেঘালয়েও ছড়িয়ে পড়েছে। শিলংয়ে শুক্রবার মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের ছাত্রদের মধ্যে মারামারির সময় ১৬ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান পূর্ব খাসি হিল জেলার সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ সিলভেস্টার নংটিনজার।

মণিপুরের ইতিহাসবিদ ও ক্যাম্পেইন ফর পিস এন্ড ডেমোক্রেসির(মণিপুর) প্রতিনিধি ড. মালেম নিংথৌজা বেনারকে বলেন, জাতিগত দাঙ্গা বন্ধ করতে সরকারকে দ্রুত সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

অবশ্য তিনি বলেন, সংবিধানের ৩৫৫ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যক্ষভাবে মণিপুরের পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে। এই ধারায় কেন্দ্রীয় সরকারকে কোন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বাইরের আগ্রাসনের মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়েছে।

ভারতের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ও সাবেক সাংসদ মেরী কম এক টুইটে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার আর্জি জানিয়েছেন।

সহিংসতার সূত্রপাত

মণিপুরে দীর্ঘ সময় ধরে উপত্যকার বাসিন্দা হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাহাড়ের খ্রিস্টান কুকি ও নাগা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ চলছে।

প্রায় ৩৪ লাখ জনসংখ্যার রাজ্যটিতে ভৌগলিকভাবে মাত্র ১০ শতাংশ জমির মালিক হলেও মেইতেই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৫৩ শতাংশ। অন্যদিকে ৯০ শতাংশ জমির অধিকারী আদিবাসীদের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। আদিবাসীরা সংরক্ষিত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পান।

মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ অনেক দিন ধরে তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি দাবি করছেন। সম্প্রতি তারা মণিপুর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ১৪ এপ্রিল মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির তালিকাভুক্ত করা যায় কিনা, তা বিবেচনা করে দেখার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়।

তফসিল উপজাতি তালিকার আওতায় এলে তারা সরকারি চাকুরি, কলেজে ভর্তি ও নির্বাচনে আসন সংরক্ষণের আওতায় চলে আসবে।

এর প্রতিবাদে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন গত ৩ মে ১০ জেলায় মণিপুর আদিবাসী সংহতি মার্চের ডাক দেয়। সেখান থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

তবে ড. নিংথৌজা দাবি করেন, সম্প্রতি মাদক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রিত পাহাড়ি এলাকায় আফিম চাষ চাষ বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে, বনাঞ্চল থেকে অবৈধ দখলদার কুকি আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এসবের কারণে কুকি ও নাগা জনগোষ্ঠীর মানুষ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

তাঁর মতে, এসবই ঘটনাই গোষ্ঠী সংঘর্ষে ইন্ধন যুগিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আদিবাসীরা মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষকে অপছন্দ করে। তারা সংযুক্ত মণিপুর গড়ে তোলার লক্ষ্যে মেইতেইদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

তবে সাইকটের বিধায়ক পাওলিয়েনলাল হাওকিপ অভিযোগ করে গণমাধ্যমকে বলেন, গত কয়েক বছরে রাজ্য প্রশাসন মণিপুরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মেরুকরণের কাজটি করেছে। যার পরিণতিতে চূড়াচাঁদপুরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে গ্রামবাসীদের উৎখাত করা হচ্ছে।

আদিবাসীদের আপত্তি

কুকি নেতাদের মতে, তফসিলি জাতিভুক্ত করার জন্য মেইতেইদের দাবির উদ্দেশ্য আসলে গোটা রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। ইতিমধ্যেই মণিপুর বিধানসভার ৬০টি আসনের ৪০টিতেই মেইতেইরা প্রতিনিধিত্ব করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে মেইতেইরা রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে এমনিই প্রভাবশালী।

আদিবাসীদের আরও অভিযোগ, মেইতেইদের তফশিলি উপজাতির সুবিধা দিলে আদিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।

অন্যদিকে মেইতেইদের অভিযোগ, আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণ থাকায় তারা পাহাড়ি এলাকায় জমিজমা ক্রয় করতে পারেন না। অথচ আদিবাসীরা উপত্যকাতেও জমি ক্রয় করার সুযোগ পান।

বিরোধীদের সমালোচনা

এদিকে মণিপুরের জাতি সংঘর্ষ নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছে।

জাতীয় কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে বলেছে, কর্ণাটকে নির্বাচনের প্রচারে ব্যস্ত না থেকে সহিংসতা কবলিত মণিপুরে দায়িত্ব পালন করুন। কংগ্রেস মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি করেছে বলে জানান দলটির মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাটে।

একই সঙ্গে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী অমিত শাহ এর পদত্যাগ দাবি করেছে কংগ্রেস।

মণিপুরে সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এখন রাজনীতির সময় নয়। রাজনীতি ও নির্বাচন অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু সুন্দর রাজ্য মণিপুরকে রক্ষা করতে হবে সবার আগে। মণিপুরে শান্তি ফেরানোর জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।