অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস
2025.02.05
ওয়াশিংটন

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের পর বাংলাদেশ জুড়ে বইতে থাকে আনন্দের জোয়ার। সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূর্যোদয়ের আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এদেশের জনগণ।
এই বিক্ষোভে প্রাণ হারিয়েছিল সাতশোর বেশি মানুষ। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির তিন দিন পর অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দায়িত্বে আসা নোবেলজয়ী মুহম্মদ ইউনূস পরিবর্তন প্রত্যাশী জনগণের উদ্দেশ্যে এক আবেগঘন আহ্বান জানান।
শপথ নেওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জনগণকে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে ইউনূস বলেন, “জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে।”
জনগণের হাতে সব ক্ষমতার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউনূস বলেন, “এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব।”
জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের বিক্ষোভ যখন রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় এবং শেখ হাসিনাকে অপসারণের দাবি গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, তখন দেশত্যাগে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
প্রথমদিকে বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)-এর তদন্তে উঠে আসে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক হাজার ৪২৩ জনের বেশি মানুষ গুলিবর্ষণ ও সংঘর্ষে নিহত হন। ছাত্রনেতা এবং আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, এ ছিল হাসিনার আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের উসকে দেওয়ার ফল।
এই অস্থিরতার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ ছিল দেশব্যাপী অশান্তি প্রশমিত করা এবং এরপর একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।

ইউনূস ও তাঁর উপদেষ্টারা বলেছেন, হাসিনার আওয়ামী লীগ প্রশাসন গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ ও ধ্বংস করেছে, যা এখন সংশোধন করা অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্লেষকদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক সংস্কার বাস্তবায়নও একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর জন্য সময় এবং ধৈর্যের প্রয়োজন।
কিন্তু দেশের বৃহত্তম দল বিএনপি, যারা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী, ধৈর্য হারাচ্ছে।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের পর ছয় মাসে ইউনূস সরকারের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত সার এখানে দেওয়া হল:
কেন সংস্কার প্রয়োজন?
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি নির্বাচনের মধ্যে মাত্র চারটি তুলনামূলকভাবে সুষ্ঠু বলে গণ্য করা হয়।
ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই প্রধান দলই নির্মমভাবে তাদের প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের দমন করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বে তাদের অনুগত লোকদের বসিয়ে দলীয়করণ করেছে।
তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংস্কার কার্যকর ও দৃঢ় হতে হলে তা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে, বিশেষ করে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন নিশ্চিত করতে হবে, যা গত নভেম্বরে করা হয়েছে। এছাড়া, নির্ভুলভাবে ভোটার তালিকা তৈরি এবং নতুন ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগ পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে তারা ভয় বা পক্ষপাত ছাড়াই নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পরই যে অরাজক পরিস্থিতি ছিল, এখন ততটা না থাকলেও ভিন্ন কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও নাজুক।
জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে দমনপীড়নের কারণে পুলিশের উপর জনগণের আস্থা কমে গেছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও, প্রতিশোধের ভয়ে পুলিশ পুরোপুরি তাদের কাজে ফিরেনি।
পুলিশের এই নির্লিপ্ততার কারণে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে--স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা।
এছাড়া ৮ আগস্টের পর দাবি আদায়ে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। যার কিছু কিছু সহিংস রূপ নিয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে বলে স্বীকার করেছে বিএনপি।

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা
২৭ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে এইচআরডাব্লিউ গুমের জন্য দায়ী কিছু ব্যক্তির নাম প্রকাশ ও গোপন বন্দিশালা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে "উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি" অর্জন করায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশংসা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনূস সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে এই সত্য উদ্ঘাটন ছিল "বহু বছর অস্বীকারের পর এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি"।
শুক্রবার পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কোনও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা হেফাজতে মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও, শুক্রবার অভিযোগ আসে যে বিএনপির যুব-শাখার একজন সদস্য সামরিক হেফাজতে মারা গেছেন ।
তবে এবার সেনাবাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে অভিযুক্ত কমান্ডারকে সরিয়ে দেয়। হাসিনার আমলে এমন ঘটনার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য না এলেও, ইউনূসের প্রেস উইং দ্রুত এই ঘটনার নিন্দা জানায়।
তবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রগোষ্ঠী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন না করায় প্রশাসনের সমালোচনা করেছে।
‘স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার, প্রতিশোধমূলক সহিংসতা’
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, “নিরাপত্তা বাহিনী হাসিনা প্রশাসনের পুরনো নিপীড়নমূলক কৌশল অব্যাহত রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সহিংসতা ও নির্বিচারে গ্রেপ্তার।”
প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ নাগরিকদেরকে "বিপুল সংখ্যক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির" বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য করেছে।
অর্থনৈতিক সংকট
ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, বাংলাদেশ "ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।" তবে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) জানিয়েছে, ইউনূস প্রশাসন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কয়েক শ’ কোটি ডলার অতিরিক্ত সহায়তা সংগ্রহ করেছে।
ডিসেম্বরে ইউনূস প্রশাসন কর্তৃক একটি শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের শাসনকালে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে গড়ে প্রতি বছর ১৬০০ কোটি মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে।
ব্রাসেলসভিত্তিক আইসিজি জানিয়েছে, বাংলাদেশ এতটাই লুটপাটের শিকার হয়েছিল যে "ইউনূস যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নামছিল, আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৫% এ উঠেছিল।"
"তিনি দক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানে বসিয়ে যে পরিবর্তন এনেছেন, তা অর্থনৈতিক সংকট ঠেকাতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।"
তবে আইএমএফ সতর্ক করেছে, মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে ১১% এর কাছাকাছি থাকবে এবং প্রবৃদ্ধি ২০২৬ সালে ৬.৭% -এ ফিরে আসবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতি
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, আন্দোলনকেন্দ্রিক সংবাদ পরিবেশনের কারণে অন্তত ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ১৫০ এর বেশি প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়েছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইউনূস জানান, মামলা দায়েরের এই ঘটনা "পুরোনো আইন ও প্রচলিত রীতিনীতির অধীনেই ঘটেছে"।
স্থানীয় গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২৯ জানুয়ারী ঘোষণা করেছে যে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য তারা শীঘ্রই প্রেস অ্যাক্রিডিটেশনের বিষয়ে সংশোধিত নির্দেশিকা জারি করবে।
বিগত নির্দেশিকায় থাকা কিছু শর্ত, যেমন, সাংবাদিকদের সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প প্রচার এবং বিদেশ ভ্রমণের আগে সরকারি সংস্থাগুলিকে অবহিত করার শর্তসমূহ অপসারণ করা হবে।
সংস্কারের পথ
তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, যেগুলো নির্বাচন ব্যবস্থার পাশাপাশি সংবিধান, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।
সংবিধান কমিশনের সুপারিশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারের বেশি না হওয়া, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা এবং প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে নির্বাহী ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়ার মতো বড় রকমের পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে এসব সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে মন্তব্য করেনি। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ হবে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের জন্য রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য অংশীদারদের সাথে একটি বৈঠকের আয়োজন করা।
নির্বাচনী ধাঁধা
“নির্বাচন কবে হবে?” এই জিজ্ঞাসা ছিল সবার মুখে মুখে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস একটি সম্ভাব্য সময়সীমা জানিয়ে দেন। কিন্তু তার উত্তর কারও কাছে “অস্পষ্ট” এবং কারও কাছে, "শিগগিরই নয়" বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।

বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করা হয়, তবে ২০২৫ সালের শেষে নির্বাচন হতে পারে। আর নির্বাচন প্রক্রিয়া, কমিশনের সুপারিশ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আরও সংস্কার করলে অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।"
ইউনূসের এ বক্তব্য ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নির্বাচনের ইঙ্গিত দেয়।
তবে বিএনপি এই বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন চায়। সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি বলছে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারই এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারে।
এখন কী হবে?
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক মনে করেন, "রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে জনগণ অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কিছুটা সময় ও স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত।" তবে, ”এই সরকার নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের আস্থা রাখতে হলে অবশ্যই ফল দেখাতে হবে," । গত ২৮ জানুয়ারি "অ্যাটলান্টিক সেন্টার"-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন তিনি।
জনসাধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো দ্রুত মেটাতে পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে বলে মত দেন মুশফিক।
ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলেছে, ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রশাসনের দুর্নীতি দমন, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর মতো দ্রুত পরিবর্তন আনে, তাহলে তা জনগণের সমর্থন অর্জন এবং বিএনপির মতো রাজনৈতিক শক্তির ওপর সংস্কার এজেন্ডা মেনে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।