সাক্ষাৎকার: দেশ সংকটমুক্ত হয়নি
2024.11.15
ঢাকা
ছাত্র ও গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম বাংলাদেশে প্রশংসা ও সমালোচনা দুটোরই মুখোমুখি হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মতে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে “ধ্বংস” করে দিয়েছে, ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য মাত্র তিন মাস “খুব বড়ো সময়” নয়। তবে এই সরকারকে “ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।” সেটি হলে “দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে।”
“দ্রুত কিছু জরুরি সংস্কার” শেষ করে সরকারকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিএনপি সময় দেয়ার পক্ষপাতি।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা বিষয়ে বেনারনিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দীর্ঘ ওই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ বিষয়ভিত্তিক আকারে নিচে তুলে ধরা হলো। ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ১০ নভেম্বর তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কামরান রেজা চৌধুরী।
প্রথম চাওয়া নির্বাচন
বেনারনিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপির প্রথম চাওয়া কী?
মির্জা ফখরুল: এই সরকারের কাছে বড়ো চাওয়া অতি দ্রুত কিছু জরুরি সংস্কার কাজ করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন। ...সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুসারে একটি পার্লামেন্ট তৈরি হবে। সেই পার্লামেন্টের মাধ্যমে একটি সরকার হবে। তারাই আরও প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করবে।
বেনারনিউজ: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। এই সরকার ব্যর্থ হলে পরিণতি কী হতে পারে?
মির্জা ফখরুল: ফ্যাসিবাদের পতন হলেও দেশ সংকটমুক্ত হয়নি। মানুষের মধ্যে এখনো নানা আশঙ্কা আছে। এই সরকার ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। ফ্যাসিস্টরা ফিরে আসার সুযোগ পেলে দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হবে।
বেনারনিউজ: এই সরকারের মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
মির্জা ফখরুল: ১৫ বছরে বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ধ্বংস করেছে। ...এই অবস্থার প্রেক্ষিতে তিন মাস খুব বড়ো সময় না। তবুও আমি মনে করি এই সময়ের মধ্যে তারা ইলেকশন কমিশন নতুন করে গঠনের জন্য কাজ শুরু করেছে, সংবিধান সংস্কারের ব্যাপারে কমিশন করা হয়েছে। …তাঁরা কাজগুলো শুরু করেছেন। আমরা এটুকু সময় তাদের দিতে চাই।
বেনারনিউজ: এই সময় দেয়ার যৌক্তিক রূপরেখা কী?
মির্জা ফখরুল: আমরা তিনটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন করতে হবে, প্রশাসনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার উপযোগী করে তুলতে হবে এবং বিচার বিভাগকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে তারা প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচার পরিচালনা করতে পারে।
বেনারনিউজ: ক্ষমতায় গেলে কি বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংবিধান সংস্কার গ্রহণ করবে?
মির্জা ফখরুল: অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলো পর্যালোচনা করে দেখবে। যৌক্তিক হলে তা গ্রহণ করবে। আর বাকি কাজের জন্য তো নির্বাচিত সংসদ থাকবেই। কারণ, সংবিধান তো পার্লামেন্ট থেকে র্যাটিফাইড (অনুমোদিত) হতে হবে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গ
বেনারনিউজ: ক্ষমতায় গেলে ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক কেমন হবে?
মির্জা ফখরুল: ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ হবে বলে আশা করি। …তবে ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে। ভারতের সাথে যৌথ নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।
বেনারনিউজ: কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখে। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মির্জা ফখরুল: আমরা বরাবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলার চেষ্টা করি যে, তোমার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা আছে তুমি দেখ। ভারতের সঙ্গে কী কী সমস্যা আছে সেটি দেখার দরকার নেই। তাহলে ভুল হবে। আমরা চাইব, ট্রাম্পের সরকার আমেরিকান দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দেখবে, আমাদের বোঝার চেষ্টা করবে।
সংখ্যালঘু, জঙ্গিবাদ
বেনারনিউজ: আওয়ামী লীগের আমলে ঢালাও মামলা, গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই সরকারের সময়েও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ধরনের মামলা হচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
মির্জা ফখরুল: একেবারেই নয়। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের অপরাধের তদন্ত তো হতেই হবে। কারণ, তারা গণহত্যা, ব্যাংক লুট ও চরম দুর্নীতি করেছে। সেক্ষেত্রে তাদের রিমান্ডে নেওয়া একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়।
বেনারনিউজ: সরকার পতনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতন, হামলা, গণপিটুনিসহ যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: সরকার পরিবর্তনের পর কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছে। যদিও এসব ঘটনা সাম্প্রদায়িক নয়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের ঘৃণা, ক্ষোভ থেকে এসব ঘটনা ঘটেছে। তবে এগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের দোসররা। বিএনপি অত্যাচার করছে অথবা বাংলাদেশ অত্যাচার করছে।– এমন একটি ইস্যু বানাতে চেয়েছিল তারা।
বেনারনিউজ: ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির ক্ষমতা থাকাকালে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আবারও ক্ষমতায় আসলে জঙ্গিবাদের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী হবে?
মির্জা ফখরুল: জঙ্গিবাদের প্রশ্নে আমাদের কোনো প্রকার সমর্থন তো ছিলই না, থাকবেও না। …আওয়ামী লীগ আসার পর জঙ্গিবাদ বেড়েছিল। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে সেটা প্রমাণ করার জন্য তারা কল্পকাহিনীও ছেপেছে।
বেনারনিউজ: তাহলে কি বলতে চান বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নেই?
মির্জা ফখরুল: আসলে বাংলাদেশে সেভাবে জঙ্গিবাদ নেই। এখানে মৌলবাদের একটা প্রবণতা আছে, যার জন্য দায়ী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করে দেওয়ায় মৌলবাদের উত্থান হয়েছে।
...রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক স্পেস সবার জন্য উন্মুক্ত না রাখলে ক্ষতি হবেই এবং সেটিই আসলে হয়েছে। ডেমোক্রেসি হচ্ছে একমাত্র পথ যা দিয়ে আপনি জঙ্গিবাদকে রুখতে পারবেন, পাশাপাশি অন্যান্য উগ্রবাদকে বন্ধ করতে পারবেন।
আওয়ামী লীগকে মাফ চেয়ে আসতে হবে
বেনারনিউজ: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জোর দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে বিএনপি কী ভাবছে?
মির্জা ফখরুল: আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, জনতা তাদের ভোটের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ জনগণ যদি কাউকে প্রত্যাখ্যান করে, সেটি তাদের বড়ো শাস্তি। এখানে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করার কিছু থাকে না।
বেনারনিউজ: সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়- দুইজনই ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ বিএনপির সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেটা কি বিএনপিও চায়?
মির্জা ফখরুল: গণতন্ত্রে উনারা বিশ্বাস করেন না, কেবল মুখে বলেন। ...জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিষয়ে আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত কোনো অনুশোচনা করেনি। তারা এই কথা কেন বলে না যে, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করেছি’, ‘আমি ছেলেদের হত্যা করেছি’, ‘খুব ভুল হয়েছে। আমাকে মাফ করে দাও’।
বেনারনিউজ: তাহলে আওয়ামী লীগকে মাফ চেয়ে তারপর আসতে হবে?
মির্জা ফখরুল: হ্যাঁ, মাফ চেয়ে তারপর কথা বলা উচিত। জনগণ মাফ করলে তারা আসতে পারবে। অন্যথায় আসতে পারবে না।
বেনারনিউজ: আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে যে খারাপ নজির স্থাপন করেছে সেই নজির আপনাদের প্রভাবিত করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
মির্জা ফখরুল: বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খারাপ কাজের সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকবে। আর সেটি না পারলে তাদেরও আওয়ামী লীগের মতো একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।