ন্যায় বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা জামায়াতের হাতছাড়া
2016.12.13
ঢাকা থেকে
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার করা দাঁড়িপাল্লাকে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। সেই মনোগ্রাম যাতে কোনও রাজনৈতিক দল নিজ প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে, সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
এ বিষয়টি কাল বুধবার নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাব্বির ফয়েজ।
তবে আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে এবার দলীয় প্রতীক হারাতে বসেছে বাংলাদেশের বিতর্কিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। কারণ, জামায়াতের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। এ প্রতীক নিয়ে বিভিন্ন সময় নির্বাচনও করেছে দলটি।
সুপ্রীম কোর্টের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করা অনেকেই। জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রতীক হিসেবে আদালতের মনোগ্রাম ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে আদালত অবমাননা করে আসছে বলে মনে করেন তাঁরা।
সুপ্রীম কোর্টের মনোগ্রামের আদলেই জামায়াতের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। ফাইল ছবি।
‘ন্যায় বিচার’ প্রতীকের দলীয় ব্যবহার নয়
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার বৈঠক করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের বিচারকেরা। সেখানে ‘ন্যায় বিচারের’ প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করতে না দেওয়ার পক্ষে মত দেন তাঁরা।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ বলেন, “ন্যায় বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেটি যেন কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে না দেওয়া হয়, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান মনোগ্রামে দাঁড়িপাল্লার দুই দিকে দুটি করে শেকল রয়েছে। এই শেকলের সংখ্যা তিনটি করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে সুপ্রীম কোর্টের ওই সভায়।
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। পরে ২০১৩ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গঠনতন্ত্রের কিছু বিষয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। বিষয়টি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত দলগুলোর তালিকায় এখনও জামায়াতের নাম ও প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা রয়েছে। তবে সেখানে হাই কোর্টের রায়ে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে বলে উল্লেখ আছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ শাখার উপসচিব আসাদুজ্জামান আরজু বেনারকে বলেন, “হাইকোর্টের আদেশে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলা হয়েছে। ওই রায় অনুযায়ী দলটির নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। এরপরে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি আর কাউকে দেওয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশ পেলে হয়ত আর কখনোই কাউকেই দেওয়া হবে না।”
বিচার ব্যবস্থাকে অবমাননা
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, আদালতের মনোগ্রাম দাঁড়িপাল্লাকে দলীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে জামায়াত বিচার ব্যবস্থার অবমাননা করছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ায় আদালতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বেনারকে বলেন, “শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে দাঁড়িপাল্লাকে ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে মেনে চলা হয়। এ প্রতীককে দলীয় প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়ে জামায়াত আমাদের বিচার বিভাগের অবমাননা করেছে। এজন্য বহু সংগঠন দীর্ঘকাল ধরে এ প্রতীক বাতিলের দাবি জানিয়ে এসেছে। দেরিতে হলেও এ রায় দেওয়ায় আদালতকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
তবে প্রতীক বাতিল নয়, একাত্তরের অপরাধের জন্য জামায়াতকে আলাদাভাবে বিচারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে জামায়াত ইসলামকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে উল্লেখ করে এটি নিষিদ্ধ করতে বলা হয়।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বিলটি মন্ত্রিপরিষদে আছে এবং যে কোনও সময় জামায়াত নিষিদ্ধ হবে বলে অসংখ্যবার জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও গত প্রায় দুই বছর ধরে সেটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়নি।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাতজন শীর্ষ নেতাতে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
শাহরিয়ার কবীর বলেন, “আইনমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন ছোট্ট একটা সংশোধনীর জন্য জামায়াত নিষিদ্ধ বিল মন্ত্রিসভায় তোলা যাচ্ছে না। কিন্তু দুই বছর ধরে কেন সেই সংশোধনী হচ্ছে না, সেটা তিনিই বলতে পারবেন।”