আইটি প্রধানসহ জেএমবির নতুন ধারার চারজন গ্রেপ্তার
2017.02.01
জেএমবির ‘সারওয়ার-তামিম’ গ্রুপের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধানসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছে র্যাব। মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় পরিচালিত এক অভিযানে তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলা চালায় জেএমবি। র্যাবের অভিযানে নিহত সারওয়ার জাহান ও পুলিশের অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরী নতুন ধারার এই জঙ্গি গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা বলে উভয় বাহিনীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বেনারকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশঙ্কা করছে জেএমবি আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে জঙ্গিগোষ্ঠী দুর্বল হয়ে পড়েছে। আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা থেকে তারা যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় জড়ো হয়েছিল। নির্মাণ শ্রমিকের পরিচয় দিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ তাঁরা বাসাটি ভাড়া নেয়,” বলেন জাহাঙ্গীর।
আশফাক-ই-আজম ছাড়াও অপর যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁরা হলেন; বগুড়ার মো. মাহবুবুর রহমান ওরফে রমি, ঝিনাইদহের মো শাহিনুজ্জামান ওরফে শাওন এবং জামালপুরের মো. আশরাফ আলী।
মো. মাহবুবুর রহমান রমি একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ও মো. আশরাফ আলী গার্মেন্টসে কাজ করতেন। শাহিনুজ্জামানের পেশা সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গ্রেপ্তারকৃত চারজনই চট্টগ্রামে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
চার জঙ্গি ছাড়াও মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পরিচালিত অভিযানে র্যাব অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধারের দাবি করেছে। উদ্ধারকৃত মালামালের মধ্যে আছে দুটি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন, ২১ রাউন্ড গুলি, সাতটি ছুরি, প্রায় তিন কেজি পরিমাণ বিস্ফোরক গুঁড়ো, পাঁচটি পাওয়ার জেল, সাতটি মুঠোফোন, তিনটি ইলেকট্রিক ডেটোনেটর, দুটি সার্কিট ব্রেকার, ছয় প্যাকেট বিয়ারিং বল, বৈদ্যুতিক তার ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম।
র্যাবের দাবি গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আশফাক-ই-আজম ওরফে আপেল জেএমবির বিভিন্ন ওয়েবসাইট ডিজাইন করত। এ ছাড়া সে জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে যোগাযোগের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
র্যাব জানায়, সারওয়ার-তামীম গ্রুপের আত্মপ্রকাশের পর সারওয়ার আশফাক-ই-আজমকে মোস্তাফিজুর রহমান সিফাতের সঙ্গে আইটি সেক্টরে কাজ করার আহ্বান জানায়। র্যাব মোস্তাফিজুর রহমান সিফাতকে গ্রেপ্তার করলে আইটি বিভাগের দায়িত্ব নেয় আশফাক-ই-আজম।
“আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আশফাক জেএমবির ওপরের সারির নেতাদের থ্রিমা, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে যোগাযোগের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কারণ ওই নেতাদের অনেকেই ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহারে দক্ষ ছিল না,” সাংবাদিকদের জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
মোস্তাফিজুর রহমান সিফাতের সঙ্গে আগে আশফাক আইএস মতাদর্শীদের ব্লগ আত-ত্বামকীনের কো-অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করেছে। এ ছাড়া সে বিভিন্ন ওয়েবসাইটেরও ডিজাইন করেছে বলে র্যাব জানায়।
আশফাকের বাড়ি রংপুরের বৈরাগীতলায়। সে ধানমন্ডির ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে ২০১২ সালে বিএসসি ইন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে। তার গুলশান, উত্তরা ও মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন আইটি ফার্মে প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
র্যাব জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বিভিন্ন ধর্মীয় বইপত্র, পুস্তিকা ও অনলাইনে বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে সে নিজেকে দীক্ষিত করে। একপর্যায়ে সে বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল ও মজলিশে যাতায়াত শুরু করে।
২০১১ সালে রংপুরের হারাগাছায় একটি মাহফিলে কামাল ও সাকিব মাস্টার নামে জেএমবির দুই কর্মীর মাধ্যমে সে সক্রিয়ভাবে জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলে কয়েকটি গোপন বৈঠকেও সে অংশ নেয়।
র্যাবের দাবি আশফাক অস্ত্র চালাতে জানে। চট্টগ্রামে অস্ত্র চালানোর ওপর প্রশিক্ষণ নেয় সে। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার কারণে সে জেএমবির আইটি শাখায় যোগ দেয়। এরপরই তাঁর সঙ্গে ‘মানিক’ নামে অপর এক জেএমবি সদস্যের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তবে মানিকই যে সারওয়ার তা সে জানত না। র্যাবের অভিযানে আশুলিয়ায় সারওয়ারের মৃত্যুর পর সে মানিকের আসল পরিচয় জানতে পারে।
র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, মো. মাহবুবুর রহমান ওরফে রমি জেএমবির ‘সারোয়ার-তামীম’ গ্রুপের একজন সদস্য, বাড়ি বগুড়ায়। সেখান থেকেই ২০১২ সালে এইচএসসি পাশ করে। বছর তিনেক পর ২০১৫ সালে বগুড়ায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করার সময় তার সঙ্গে আশফাকের পরিচয় হয়। আশফাক তাঁকে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
র্যাব বলছে, মাহবুবের দায়িত্ব ছিল বগুড়া অঞ্চলে জেএমবির গোপন পার্সেলগুলো জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া। আশফাকের হাত ধরেই সে পুরনো জেএমবি থেকে নতুন ধারার জেএমবিতে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অস্ত্র চালনা শিখতে চট্টগ্রামে চলে যায়।
গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামি ঝিনাইদহের মো. শাহিনুজ্জামান শাওন (৩০)। র্যাবের ভাষ্য, সে জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখার আমির মাহমুদুল ইসলামের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। মাহমুদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে মিরপুরে প্রশিক্ষণ নেয়। ২০১৫ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রামে অস্ত্র প্রশিক্ষণের সময় অসতর্কতায় তার নিজের পায়ে গুলি লাগে।
জামালপুরের মো. আশরাফ আলী (২৪) স্থানীয় এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে জেএমবিতে যুক্ত হয়। অষ্টম শ্রেণি পাস আশরাফ ২০১৪ সালে সাভারে চলে আসে। ইপিজেড এলাকায় বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সে কাজ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিবাদ দমনে ভালো করছে। তবে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনের জন্য আরও অনেক কিছু করণীয় আছে।
“জঙ্গিবাদ দমনে এখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। মানুষকে জঙ্গিবাদ থেকে দূরে সরাতে হলে শিক্ষাখাতে ব্যাপক কাজ করা প্রয়োজন। নইলে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণ ঠেকানো যাবে না। নজরদারি ও অভিযানের পাশাপাশি অন্য দিকেও কাজ করা দরকার,” বলেন জিয়া রহমান।