মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকলেও এখন জেএমবি ও আনসারুল্লাহর সদস্যরা পরষ্পরের সহযোগী

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.11.17
মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকলেও এখন জেএমবি ও আনসারুল্লাহর সদস্যরা পরষ্পরের সহযোগী গ্রেপ্তার হওয়া এই পাঁচ ব্যক্তি জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের সদস্য বলে র‍্যাবের দাবি। নভেম্বর ১৭, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

পুলিশ ও র‍্যাবের কর্মকর্তারা এতাদিন বলে আসছিলেন যে, জেএমবি ও আনসারুল্লাহর মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত বুধবার রাতে পাঁচ জঙ্গিকে আটক করার পর র‍্যাব বলছে, এদের তিনজনই আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে তাঁরা জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে যোগ দেয়।

র‍্যাব বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনই জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের সদস্য। এই জঙ্গি দলকেই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ‘নব্য জেএমবি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত নিউ জেএমবি ও আনসারউল্লাহ বাংলা টিমকে পরস্পরের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, ২০১৫ সালের শেষ দিকে আনসারউল্লাহ অর্থসংকটে পড়লে নিউ জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। এরপর আনসারউল্লাহকে অস্ত্রও সরবরাহ করেন তামিম।

যদিও নিউ জেএমবির সংঘটিত প্রায় সবগুলো হামলা বা হত্যার দায় স্বীকার করেছে ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য আইএসের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।

মতাদর্শগত বিরোধিতার পরেও আনাসরুল্লাহ সদস্যদের নব্য জেএমবিতে যোগদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘তাদের (জঙ্গিদের) নীতিগত কিছু বিষয় থাকলেও কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার একসঙ্গে জড়ো হয়।’

গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে নব্য জেএমবির সদস্যরা আইএস আর আনসারুল্লাহর সদস্যরা আল কায়েদাকে অনুসরণ করে। উভয়পক্ষের লক্ষ্য এক। তবে আইএস এলোপাতাড়ি হামলা ও হত্যায় বিশ্বাস করে। আর আল কায়েদা লক্ষ্য স্থির করে সুনির্দিষ্ট আঘাত করে।

র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলন

জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পিস্তল, গুলি ও ম্যাগজিন।
জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পিস্তল, গুলি ও ম্যাগজিন।
নিউজরুম ফটো।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বুধবার রাত সোয়া আটটার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে আবদুল হাকিম ফরিদী ওরফে সুফিয়ান (৪০) ও রাজিবুল ইসলাম (২৯) নামে দুজনকে আটক করা হয়।

পরে তাঁদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা হলেন; গাজী কামরুস সালাম সোহান ওরফে আবু আবদুল্লাহ (২৭), সোহেল রানা ওরফে খাদের ওরফে শহীদুল্লাহ ওরফে সোহেল এবং শেখ মো. আবু সালেহ ওরফে লিটন ওরফে হুরাইয়া (৪২)। তাদের কাছ থেকে পিস্তল, গুলি ও ম্যাগজিন উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র‍্যাব।

পাঁচ জঙ্গির পরিচয়

র‍্যাব জানায়, গাজী কামরুস সালাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) পড়াশোনা শেষ করেছে্। এরপর ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিতে (ডেসকো) চাকরি নেয়। ডেসকো থেকে জানানো হয়, প্রায় দুই বছর আগে হঠাৎ করে অফিসে যাওয়া বন্ধ করেন কামরুস সালাম।

আইইউটিতে পড়ার সময় কামরুল তার বন্ধু সিফাতের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে যুক্ত হন। জঙ্গি ওয়েবসাইট আত-ত্বামকীন মিডিয়া পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সিফাতকে গত ৯ আগস্ট গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। সিফাত আইইউটিতে পড়ার সময় জসমীউদ্দীন রাহমানির মতাদর্শের জঙ্গিবাদে যুক্ত হন। এই সিফাতই পরে নব্য জেএমবির নেতা সারোয়ার জাহানের সঙ্গে কামরুস সালামের পরিচয় করিয়ে দেন।

র‍্যাব জানায়, কামরুস সালাম উত্তরবঙ্গে ১১ দিনের প্রশিক্ষণ নেন, এরপর চট্টগ্রামে ক্ষুদ্রাস্ত্র ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। তাঁর অন্যতম কাজ ছিল সমর্থকদের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করা এবং আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতা করা। তাঁর কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

র‍্যাব জানায়, আনসারুল্লাহ থেকে জেএমবিতে আসা আরেকজন আবদুল হাকিম ভালো বক্তা ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক। আনসারুল্লাহর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা এ ব্যক্তি জসীমউদ্দীন রাহমানির সঙ্গেও বক্তৃতা দিয়েছেন।

জসীমউদ্দীন গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাকিম তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন বলে র‍্যাবের কাছে তথ্য রয়েছে। হাকিমও প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জেএমবিতে যুক্ত হন। বিভিন্ন সভা সেমিনারে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর পরিচিতির ক্ষেত্রটা ছিল অনেক বিস্তৃত।

এই হাকিমের মাধ্যমে গত বছরে জেএমবিতে যোগ দেন রাজিবুল ইসলাম। রাজিবুল ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জসীমউদ্দীন রাহমানির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।

এ সময় র‍্যাব দাবি করেছে রাজিবুলকে গত বুধবার রাজধানীর বিমানবন্দর স্টেশন এলাকা থেকে ধরা হয়েছে। প্রায় এক বছর আগে নিখোঁজ হন রাজিবুল।

তবে তাঁর ভাই রবিউল ইসলাম টেলিফোনে বেনারকে জানান, গত ২৭ জানুয়ারি রাজিবুলকে সাতক্ষীরার তালা এলাকার ভাড়া বাসা থেকে র‍্যাবের পরিচয়ধারীরা ধরে নিয়ে যায়। তাঁর দাবি, তাঁদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজিবুল কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয় বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।