এ পর্যন্ত আত্মসমর্পণকারী ২৪ জঙ্গির ৭ জন কারাগারে, বাকিদের অবস্থান ধোঁয়াশা
2016.12.01

জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর সরকারের আহ্বানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ২৪ জন সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁদের কেউই কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়াননি বলে জানিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। এদের অনেককেই পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হলেও সাতজন কারাগারে আছেন।
তবে আত্মসমর্পণের পর সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে বন্দী রাখাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করা এসব ব্যক্তিদের পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের ব্যবস্থা প্রয়োজন। না হয় তাদের মধ্যে ‘আত্মসমর্পণ করে ভুল করেছেন’- এমন অনুভূতি আসতে পারে।
এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আত্মসমর্পণ করা ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে অন্যান্য জঙ্গিদের আটকের চেষ্টাও চলছে। তবে এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থ জীবনে ফেরাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর সারা দেশে জঙ্গি বিরোধী প্রচারণা শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক একাধিকবার জঙ্গিবাদে জড়িত তরুণরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলে তাদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
আত্মসমর্পণকারীদের পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়। এরপরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গিবাদে জড়ানো এই ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করেন।
পুলিশ ও র্যাব সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত সারা দেশে ২৪ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। এর মধ্যে তিন দফায় যশোরে হিযবুত তাহরীরের সাতজন, বগুড়ায় র্যাবের কাছে নব্য জেএমবির দুজন, রংপুরে র্যাবের কাছে জেএমবির ৩ জন এবং পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে ১২ জন আত্মসমর্পণ করেন।
আত্মসমর্পণ করা এসব জঙ্গিদের মধ্যে যশোরের সাতজন এখন কারাগারে রয়েছেন। র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা দুজন গত ১১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরায় র্যাব-১ এর কার্যালয়ে ছিলেন।
তবে গতকাল তাদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সিটিটিসির কাছে আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিরা পুলিশের নজরদারিতে নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম।
জানতে চাইলে অপরাধ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বেনারকে বলেন, “জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের সংশোধন জরুরি। তাদের কেউ সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত না হলে কারাগারে বা বন্দী রাখা উচিত নয়। তবে আত্মসমর্পণের আগে কেউ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়লে প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করতে হবে।”
এদিকে যশোরের সাত জঙ্গি সম্পর্কে জানতে চাইলে যশোর জেলা পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বেনারকে বলেন, “নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করা সাত জঙ্গির সরাসরি কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে তাঁদের নামে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় আত্মসমর্পণের পরই তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি জানান, “সেখানে তাদের সংশোধন প্রক্রিয়া চলছে। কারামুক্তির পর তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”
কারাগারে সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে যশোর বিভাগের ডিআইজি (প্রিজন) টিপু সুলতান বেনারকে বলেন, “ওই সাতজনকে পৃথক পৃথক সেলে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তাঁদের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।”
তিনি বলেন, “ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাঁরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিলেন। কারাগারের ইমামের মাধ্যমে তাঁদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে।”
গত ৫ অক্টোবর বগুড়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন আবদুল হাকিম (২২) ও মাহমুদুল হাসান ওরফে বিজয় (১৭) নামে দুই জঙ্গি। এরপর তাঁদের ঢাকায় আনা হয়।
এই দুজন কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়ানোর আগেই আত্মসমর্পণ করেছেন জানিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আগ্রহের কথা জানান।
আত্মসমর্পণের পর থেকে হাকিম র্যাবের হেফাজতেই রয়েছেন বলে বেনারকে জানান আবদুল হাকিমের বড় ভাই আবদুল আলিম। মাহমুদের চাচাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমানও একই তথ্য দিয়ে বলেন, “মাহমুদ পরিবারের কারও সঙ্গে নেই। র্যাবের হেফাজতেই রয়েছে।”
তবে যোগাযোগ করা হলে গতকাল র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে বলেন, “আত্মসমর্পণের পরই তাদেরকে পরিবারের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা র্যাবের হেফাজতে নেই।”
গত ১১ অক্টোবরের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, “হয়ত তখন তাঁরা কোনো প্রয়োজনে এসেছিল। নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা মাঝে মধ্যেই আসেন।”
গত ২৩ নভেম্বর রংপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন দিনাজপুর ঘোড়াঘাট উপজেলার হাফেজ মাসুদ রানা ওরফে হাফেজ মাসুদ, হাফিজুর রহমান ও আকতারুজ্জামান ওরফে আকতারুল ইসলাম। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব। এরা তিনজনই মাদ্রাসার ছাত্র, দুজন নবম ও একজন দশম শ্রেণিতে পড়ছেন।
গত ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের অদূরে হামলাকারী ‘জঙ্গি’ শফিউলে মাধ্যমে তারা উগ্রবাদে ঝুঁকেছিলেন বলে জানায় র্যাব।
সিটিটিসি সদস্যদের কাছে আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জঙ্গি সংগঠনের ১২ সদস্য স্বেচ্ছায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এসে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁরা এখন পরিবারের হেফাজতেই আছেন।”
তিনি বলেন, “নিরাপত্তার জন্য তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হলেও তারা পুলিশের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাঁদের সংশোধনের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।”
এসব আত্মসমর্পণের পর জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের সংশোধনের জন্য মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বেনারকে বলেন, “কথিত মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে তাদের জঙ্গিবাদে জড়ানো হয়। মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিয়েই তাদের মাথা আবার ঠিক করতে হবে।”
এ ছাড়া সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ যেন আত্মসমর্পণ করা ব্যক্তিকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত না করে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্য হলে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো যায়। কিন্তু অপরাধ করার আগে কেউ আত্মসমর্পণ করলে তাঁর শুদ্ধির ব্যবস্থা করাই বাঞ্ছনীয়, এতে অন্যরা উৎসাহিত হবে। আর তা না করে কারাগারে রাখা হলে অন্যরা নিরুৎসাহিত হবে।”