এক সপ্তাহে আবার ৯ তরুণ নিখোঁজ, জঙ্গি দলে যোগদানের আশঙ্কা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.12.07
রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ চার তরুণ। রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ চার তরুণ। ফাইল ছবি
স্টার মেইল

গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এক সপ্তাহে রাজধানীসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয় তরুণ নিখোঁজ হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, তারা জঙ্গিবাদে যুক্ত হতে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছে।

এর আগে চলতি বছরের শুরুর দিকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের কয়েকজনকে পরে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, তা ঠিক নয়। তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।

নিখোঁজ হওয়ার ধারাবাহিকতায় প্রথমে গত ২৯ নভেম্বর নিখোঁজ হন রাজধানীর কেয়ার মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছাত্র ইমরান ফরহাদ। ৩০ নভেম্বর দুপুরে নিখোঁজ হন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের জামিয়াতুল নাফিজিয়া আল ইসলামিয়া মার্কাস মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নেয়ামাতুল্লাহ বেপারী (১৬)।

একই দিনে (৩০ নভেম্বর) দেশের আরেক প্রান্ত পাবনা থেকে নিখোঁজ হন পাবনা মেডিকেলের ছাত্র তানভীর আহমেদ তনয়। পরদিন ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন তানভীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাকির হাসান, যিনি পাবনা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

একই দিনে (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর বনানীর নর্দান ক্যাফে রেস্তোরাঁয় নাশতা করার পরে এক যোগে নিখোঁজ হন চার তরুণ। এরা হলেন; সাফায়াত হোসেন, জাইন হোসেন খান (পাভেল), মেহেদি হাসান হাওলাদার ও মো. সুজন। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।

তাঁদের মধ্যে সাফায়াত ও জাইন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেহেদি বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র। আর সুজন ড্যাফোডিল থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে কোর্স করে বিজ্ঞাপ​নী সংস্থা এশিয়াটিকে কাজ করতেন।

সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর রাজধানী থেকে নিখোঁজ হন ‘ও’ লেভেল পাস করা তরুণ সাঈদ আনোয়ার খান।

যে অবস্থায় নিখোঁজ

২৯ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ইমরানের মা সাবিনা ইয়াসমিন ২ ডিসেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

ইমরানের আত্মীয় মো. আল-মামুন বেনারকে বলেন, “প্রতিদিনের মতো গত ২৯ নভেম্বর সকালে মোহাম্মদপুরে অবস্থিত কেয়ার মেডিকেল কলেজে যাওয়ার জন্য ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন মাটিকাটার বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ইমরান। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ।”

জিডির তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল গফুর সাংবাদিকদের বলেন, “ছেলেটি মাটিকাটার বাসা থেকে ব্যাগ ও মুঠোফোন নিয়ে বের হয়েছিল। এরপর আর ফেরেনি। তার মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।”

৩০ নভেম্বর বরিশালের আগৈলঝাড়ার জামিয়াতুল নাফিজিয়া মাদ্রাসার ১৬ বছর বয়সী ছাত্র নেয়ামত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গত ৪ ডিসেম্বর রাতে আগৈলঝাড়া থানায় একটি জিডি করেন তার বাবা খোরশেদ ব্যাপারী। জিডিতে বলা হয়েছে, গত ৩০ নভেম্বর জোহরের নামাজ পড়েই সে মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হয়।

ছেলের মা কোহিনূর বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পরে তাঁকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বরিশালে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কার্যালয়ে খুঁজতে। তিনি তা-ই করেছেন, কিন্তু ছেলেকে পাননি।”

কোহিনূর বলেন, নিখোঁজ হওয়ার পর গত মঙ্গলবার তাঁর ফোনে একটি খুদে বার্তা আসে। তাতে লেখা রয়েছে, “মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি যেথায় থাকি না কেন চিন্তা করবে না।”

বার্তাটির শেষে তাঁর ছেলের নাম লেখা। তবে এটি তাঁর ছেলের নম্বর থেকে নয়, অন্য নম্বর থেকে এসেছে। তাঁরা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছেন।

৩০ নভেম্বর পাবনা মেডিকেলের এক ছাত্র ও পরদিন আরেক ছাত্র নিখোঁজ হন। দুজনেই চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে ছাত্রাবাসে থাকতেন তাঁরা। এ ঘটনার রাতেই পাবনার সদর থানায় একটি জিডি করা হয়।

১ ডিসেম্বর চারজন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বনানী থানায় দুটি জিডি হয়েছে। সাফায়েত, জাইন ও সুজনের নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেছেন জাইনের বাবা ইসমাইল হোসেন খান। আরেকটি জিডি করেছেন মেহেদির চাচা মাহবুব তালুকদার।

জিডি দুটির তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা বেনারকে বলেন, সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বনানী কাঁচাবাজার এলাকার নর্দান ক্যাফে রেস্তোরাঁয় চার তরুণকে একত্রে দেখা গিয়েছিল। এরপর থেকেই তাঁরা নিখোঁজ। তাঁদের খোঁজাখুঁজি চলছে।

সর্বশেষ বনানী থেকে গত সোমবার দুপুরে সাঈদ আনোয়ার খান নামের আরেক তরুণ নিখোঁজের ব্যাপারে থানায় জিডি করা হয়েছে। ব্যবসায়ী বাবা আনোয়ার সাদাত খান বনানী থানায় এই জিডি করেছেন।

জিডিতে উল্লেখ করা হয়, গত সোমবার দুপুরে বাসা থেকে বেরিয়ে সে আর ফেরেনি।

পুলিশ খোঁজ নিচ্ছে

তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার প্রবণতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম বেনারকে বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোতে সাধারণত দুভাবে নিয়োগ হয়। কেউ সরাসরি বায়াত (দীক্ষা) নেয়। আবার কেউ অনলাইনে নিজে নিজেই উদ্বুদ্ধ হন। তরুণদের ক্ষেত্রে অনলাইনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

“আমরা বলছি না যে সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া তরুণেরা জঙ্গি সংগঠনেই যোগ দিতে গেছেন। এ বিষয়ে পুলিশ এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে,” জানান মহিবুল।

পুলিশ নিশ্চিত না হলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশের অভিযানে দু-একজন জঙ্গি নেতা নিহত হওয়ার পরে অনেকেই বলেছিলেন জঙ্গিবাদ দমনে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। যে জেএমবিকে ছয়-সাত বছর আগেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে, সেই জেএমবি আবার ধ্বংসাত্মক হয়ে ফিরে এল কীভাবে—এটা বুঝতে হবে।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোতে নেতাদের মৃত্যু হতে পারে—এটা ধরে নিয়েই তারা পরিকল্পনা করে। তাদের মধ্যে ঠিক করা থাকে একজন মারা গেলে তার জায়গায় কে দায়িত্ব নেবেন। তাই সাম্প্রতিক অভিযানে কয়েকজন মারা গেছে বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এরা থেমে গেছে বা শেষ হয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।