১১ বছর পর পাঁচ জেএমবি সদস্যের যাবজ্জীবন
2016.03.28
নাটোরের আটটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পাঁচ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন আদালত। প্রায় ১১ বছরের বিচারকাজ শেষে সোমবার দুপুরে এই সাজা দেন নাটোরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২।
অর্থদণ্ড পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে আসামিদের আরও এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। নাটোরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক প্রদীপ কুমার রায় সোমবার দুপুর ১২টার সময় প্রকাশ্য আদালতে রায় পড়ে শোনান। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ ও খালাসপ্রাপ্ত দুই আসামি কারাগারে আটক আছেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবির সদস্যরা নাটোরের আদালত চত্বর, উকিল বার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ট্রেজারি অফিস, নাটোর প্রেসক্লাব, বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশন এলাকায় একযোগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ আহত হন। বিকট শব্দে ওই সব এলাকায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক প্রদীপ কুমার রায় জানান, “দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই নির্বাহী হাকিমের কাছে অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। জবানবন্দি বিশ্বাস না করার মত কোনো কারণ আসামি পক্ষ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।”
দুই পক্ষের আইনজীবীরা যা বললেন
“সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে এই রায় ভূমিকা রাখবে। এই রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে যুবসমাজ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে পরিহার করবে,” রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আব্দুল হাই স্থানীয় সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
“ন্যায়বিচারের আশায় আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন,” জানান আসামি পক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ মোজাম্মেল হোসেন।
তিনি জানান, “একই তারিখ ও সময়ে অন্য জেলায় বিস্ফোরণ ঘটানোর মামলায় কিছু আসামির ইতিমধ্যে সাজা হয়েছে। ওই সব আসামিদের এই মামলার একই সময়ের ঘটনায় সাজা দেওয়া আইনানুগ হয়নি।”
পাঁচজনের সাজা, দুজন খালাস
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা হচ্ছে; নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কাজির মোড়ের ফজলুল হকের ছেলে হাফিজুর রহমান ওরফে নোমান (৩০), নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খোলাবাড়িয়ার ফজলার রহমানের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (৩০), রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার গোগ্রামের ওমর আলীর ছেলে সিহাব উদ্দিন ওরফে হানজালা (৩০), বাগমারা উপজেলার হামিরকুশা গ্রামের শাহাদত হোসেনের ছেলে আব্দুল মতিন (৩০) ও বগুড়া জেলার গাবতলি উপজেলার চক জাদু গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে আব্দুর রশিদ ওরফে আশিক (৩৩)।
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের নাসির উদ্দিনের ছেলে শহিদুল ওরফে ফারুক (৩৬) ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ইটাগাছা গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে শফিউল্লাহ ওরফে তারেক (৩২)। আসামি তারেক বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত না থাকায় তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময়ও আসামি তারেক ছাড়া বাকিরা আদালতের এজলাসে উপস্থিত ছিল।
এর আগে অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় জামালপুর সদর উপজেলার চরসী খলিফাপাড়ার আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের ছেলে শায়খ মোহাম্মদ আবদুর রহমান, বগুড়ার গাবতলি উপজেলার চুনিপাড়া গ্রামের নাজির হোসেনের ছেলে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও নাটোরের সিংড়া উপজেলার কালিগঞ্জ গ্রামের হামিদ আলীর ছেলে আবদুল আউয়াল ওরফে আসিককে এই মামলা থেকে আদালত অব্যাহতি দেন।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে আসামিদের গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। মঙ্গলবার থেকেই সংশ্লিষ্ট বিচারক, সরকারি কৌঁসুলি ও আদালতের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মামলার ইতিবৃত্ত
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ওই ঘটনার দিন পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে জিহাদি বই ও জেএমবির প্রচারপত্র উদ্ধার করে। নাটোর সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা করেন।
তদন্ত শেষে নাটোর সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান ২০০৫ সালের ১০ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তদন্তকালে আসামি হাফিজুর রহমান, দেলোয়ার হোসেন, সিহাব উদ্দিন, আবদুল মতিন ও আব্দুর রশিদ বিচারিক হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এই মামলায় মোট ৭৫ জন সাক্ষীর মধ্যে সরকার পক্ষ ৪২ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করে। সাক্ষ্য প্রমাণে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় আদালত আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
আসামিদের মুখে হাসি!
স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক বেনারকে জানান, রায় পড়ে শোনানোর পর আসামিদের হাসতে দেখা গেছে।
এ সময় আসামিরা বিচারকের কাছে জানতে চায়, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে যে হাজতবাস করেছেন তা সাজা থেকে বাদ যাবে কি না?
আদালত এ ব্যাপারে পরে মতামত জানাবেন বলে আসামিদের জানান। পরে বিশেষ পাহারায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নাটোর কারাগারে পাঠানো হয়।