খালেদা জিয়ার ঐকমত্যে ইসি গঠনের প্রস্তাব, সরকারি দলের প্রত্যাখ্যান
2016.11.18
সবগুলো রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তিনি আনুষ্ঠানিক এই প্রস্তাব দিলেন।
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের বিভিন্ন ধারায় সংশোধন আনা, কমিশন সচিবালয়কে শক্তিশালী করার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এখন যে কমিশন গঠন হবে, তার নেতৃত্বেই অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন।
তবে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার দেওয়া ফর্মুলাকে অন্তঃসারশূন্য এবং জাতির সঙ্গে তামাশা বলে উল্লেখ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইসি গঠন বিষয়ে খালেদা জিয়া প্রস্তাব দেওয়ার পর পরই ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তব্য রাখেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ইসি গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিই ঠিক করবেন কাকে রাখবেন বা রাখবেন না। এখানে তাঁদের বা অন্য কারও কিছু করার নেই।
গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে ‘নির্বাচন কমিশন গঠন এবং শক্তিশালীকরণ: বিএনপির প্রস্তাবাবলী’ শীর্ষক উপস্থাপনায় খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। তাঁর প্রস্তাবে ভোটগ্রহণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা পরিবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। তিনি নির্বাচনকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তিনি প্রতিরক্ষাবাহিনীকে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে আরপিও সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব করেন।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ব্যারিস্টার রফিক উল হক খালেদা জিয়ার বিভিন্ন প্রস্তাবের মধ্যে এই অংশের বিরোধিতা করেছেন। বিএনপির আমন্ত্রণে রফিক উল হক ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর এক প্রশ্নের জবাবে রফিক উল হক বেনারকে বলেন, “সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ আনার বিষয়টি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। এ ছাড়া প্রস্তাবের বিভিন্ন জায়গায় পরোক্ষভাবে জামায়াতের কথা টেনে আনা হয়েছে, যেটি গ্রহণযোগ্য নয়।” তবে প্রস্তাবে অনেকগুলো ভালো বিষয় থাকার কথা উল্লেখ করে প্রবীণ ওই নাগরিক এ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত বলে মত দেন।
প্রস্তাবে খালেদা জিয়া নতুন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার আগে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করার কথা বলেন। ওই কমিটি দলগুলোর দেওয়া নাম থেকে যে নামগুলো অভিন্ন হবে সেগুলো থেকে সিইসি পদে দুজন ও প্রত্যেক কমিশনারের বিপরীতে দুজনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে সিইসি ও ইসি নিয়োগ করবেন।
অবশ্য এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে তা মনে করেন না খালেদা জিয়া। তিনি মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনকে প্রশাসনিক ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে জাতির সামনে উপস্থাপন করার কথা জানান খালেদা জিয়া।
বিএনপির চেয়ারপারসন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেন। বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মক্ষম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে ছিলেন না।
অপর সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি ও একজন সচিব। এঁরা হবেন অবসরপ্রাপ্ত এবং তাঁদের নিয়ে বিতর্ক থাকবে না। অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবেন দল নিরপেক্ষ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। শিক্ষাবিদ হিসেবে সুখ্যাতি থাকতে হবে। কমিটিতে একজন নারীকে রাখতে হবে। তিনি হবেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, দল নিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ ও যোগ্য।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রী পরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কর্মকর্তা বাছাই কমিটির সদস্য হতে পারবেন না। দলগুলোই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত পৃথক পৃথক বৈঠকে বাছাই কমিটির সদস্য নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুজনের নাম প্রস্তাব করবে।
খালেদা জিয়া বলেন, সিইসিকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৎ, মেধাবী, দক্ষ, নৈতিকতা সম্পন্ন এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন অথবা একজন সচিব যিনি অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে ছিলেন না অথবা একজন বিশিষ্ট নাগরিক সিইসি পদে নিয়োগ পেতে পারেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে, তিনি বিতর্কিত নির্বাচন চান না। একই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখি।”
“আমরা বলে আসছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটা আইন করা হোক। আইনে মোটা দাগে তিনটা বিধান থাকতে হবে। এগুলো হচ্ছে; যোগ্যতার মাপকাঠিগুলো সুস্পষ্ট করা, অনুসন্ধান কমিটি এবং একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার বিধান রাখা,” জানান ড. বদিউল আলম।
তাঁর মতে, একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বে অনুসন্ধান কমিটিতে ক্ষমতাসীন দল এবং প্রধান বিরোধী দলের দুজন প্রতিনিধি, সেই সঙ্গে যদি গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয় তাহলে যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য: ওবায়দুল কাদের
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার ৪৫ মিনিটের অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য প্রমাণ করেছে, তিনি জনগণের ওপর আস্থাশীল নন। তাঁর বক্তব্যে এমন কিছু প্রসঙ্গ এসেছে, যা ইতোমধ্যে আমাদের সংবিধান এবং নির্বাচন আইনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা সংবিধান মোতাবেক চলতে চাই। এর আগে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন। সেই প্রক্রিয়াই আমাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখান থেকে আমরা বিচ্যুত হচ্ছি না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ইসি সংস্কারের ফর্মুলায় বাংলাদেশের জনগণের ওপর কিংবা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ-র্যাব, বিজিবির প্রতি তাঁর (খালেদা জিয়া) আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, জাতির কাছে খালেদা জিয়ার এই ধরনের প্রেসক্রিপশন দেওয়ার আগে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার নামে মানুষ হত্যা, আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, তাঁর ছেলে তারেকের মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতি, নিজের ভুয়া জন্মতারিখ নিয়ে জাতির সঙ্গে মিথ্যাচারের জন্য।
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের কোনো কিছুই কি গ্রহণযোগ্য নয়—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন এত ভালো ভালো কথা কোথায় ছিল? এগুলো কোথায় ছিল মাগুরা উপনির্বাচনের সময়। কোথায় ছিল ঢাকা-১০ ও মিরপুরের উপনির্বাচনের সময়?”