ঢাকার রাজনীতিতে একের পর এক ‘কিংস পার্টি’র আবির্ভাব
2023.11.22
ঢাকা
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে বিরোধী দল বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুটো রাজনৈতিক দল।
বুধবার ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে “যুক্তফ্রন্ট” নামে নতুন জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোটের একসময়কার পরিচিতমুখ মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তাঁর কল্যাণ পার্টির সঙ্গে এই নতুন জোটে যোগ হয়েছে বিএনপির জোটের আরেক দল লেবার পার্টি। অথচ, কয়েকদিন আগেও ইবরাহিম বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়াকে “আত্মহত্যার সামিল” বলে মন্তব্য করেছিলেন।
অকস্মাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে ইবরাহিম বলেন, “আমি এবং আমার নেতা-কর্মীরা কষ্ট করে রাজনীতিটাকে টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের টিকে থাকার একটা সীমা আছে। সেই সীমা আমরা ধরে রেখেছি। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে রাজনৈতিক অক্ষমতা হলো, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আর পেরে উঠছি না।”
“আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে — নিশ্চুপ থাকব নাকি বিকল্প পন্থা অবলম্বন করবো। গত ২৮ অক্টোবরের পর এটা একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বিকল্প পন্থা বেছে নিলাম। কারণ, আমি যে কথাগুলো বলার চেষ্টা করি, সেটা সংসদে গিয়ে বলবো।”
কোনো ধরণের চাপের কারণে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা আমার পক্ষে এখন সমীচীন হবে না।”
কল্যাণ পার্টির পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় জাতীয় পার্টি। সরকারের সঙ্গে দলটির মৈত্রী থাকলেও এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জাতীয় পার্টির দোদুল্যমান অবস্থান ছিল। চুন্নু এর আগে বেনারকে বলেছিলেন, নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগের কারচুপি ও বিরোধী দল বিএনপি না থাকায় স্বল্প ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তাঁর দলের শঙ্কা রয়েছে।
“নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল মাধ্যম থেকে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে। ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে,” বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে জানান চুন্নু।
“তাদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করছি।”
তিনি জানিয়েছেন, কোনো জোটের অধীনে না গিয়ে এককভাবে ৩০০ নির্বাচনী আসনে প্রার্থী দেবে তাঁর দল।
আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
জাতীয় পার্টির পাশাপাশি “তৃণমূল বিএনপি”, “বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট” ও “স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ” নামে সংগঠন গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতা।
তৃণমূল বিএনপি’র নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার। এছাড়াও বিএনপির বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার লক্ষ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
তবে দলছুট কোনো নেতাই বিএনপিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না। শমসের মবিন চৌধুরী ক্যন্সার সহ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে প্রায় আট বছর আগে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। অপরদিকে তৈমুর আলম খন্দকার অনেকদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতেই কোণঠাসা ছিলেন। এছাড়া যেসব সাবেক সংসদ সদস্য নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন বা বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন দলের ৫০২ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সদস্য।
তারপরও পুরো বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের সন্তুষ্টি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না।
বুধবার বিকেলে দলের এক সমাবেশে শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “ফুল কিন্তু ফুটতে শুরু করেছে। আরও অনেক ফুল ফুটবে। মনোনয়ন ফরম সরকারিভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া পর্যন্ত শত ফুল ফুটবে। কাজেই এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। উই আর হ্যাপি।”
‘কিংস পার্টি’
বিএনপির পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ করা হয়েছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার নিজেদের ছত্রছায়ায় “কিংস পার্টি” গঠন করে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে। আগেও নির্বাচনের সময় বিএনপি এই ধরণের অভিযোগ তুলেছিল।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধরণের কয়েকটি দল গঠনের কথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রচলিত আছে। তবে সেই সময় গঠিত কল্যাণ পার্টি ছাড়া বাকি সব দলই এখন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
“সরকার বা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা এই উপমহাদেশে নতুন নয়। কিন্তু এসব করে চূড়ান্তভাবে লাভ হয় না,” বেনারকে বলছিলেন সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার আবু আলম মো. শহিদ খান।
বিষয়টি নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বেশ তীব্রভাবে সরকার ও দলছুট নেতাদের খোঁচা দিয়েছেন বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
“শেখ হাসিনার সরকার এখন মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের মতো তথাকথিত কিংস পার্টি, ভুঁইফোড় পার্টি, ড্রিংকস পার্টি, ছিন্নমূল পার্টি তৈরি করে তাদের দিয়েই তামাশার নির্বাচন মঞ্চস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন,” বলেন তিনি।
“বিভিন্ন দল থেকে নেতা কিনতে গরুর হাটের মতো দরদাম চলছে।”
বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বেনারকে বলেন, “নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমাদেরও নিয়মিত চাপ দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভোটে গেলে জায়গা হবে সংসদে – না গেলে মির্জা ফখরুলদের মতো জেলে।”
“আমাদের দলের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনে রাজপথে থেকে আমরা জেলে যেতে প্রস্তুত, তবু কোনো তামাশার নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে যাব না,” বলেন তিনি।
গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনএম-এর দায়িত্বে থাকা তৈমুর আলম খন্দকার, যিনি ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী হয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছিলেন।
পরবর্তীতে সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একে “রাষ্ট্রীয় বিষয়” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
আবু আলম মো. শহিদ খান বলেন, বিএনপি’র অনুপস্থিতির কারণে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি – এই সমালোচনা থেকে রেহাই পেতেই মূলত সরকার নতুন নতুন দল গঠন নিয়ে তৎপর।
“নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার বিষয়টি দুই রকম। প্রথমত, রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ। বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের বাইরে থাকে, এটাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যায় না।”
“আবার যদি নির্বাচনের দিন সত্যিকার অর্থেই বিপুল সংখ্যক ভোটার উপস্থিত হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।
“তবে সেটা হবে কি না তা দেখার জন্য ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”