জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার দায়ে ৫ জঙ্গির ফাঁসি
2017.02.28
জাপানের নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যা মামলায় পাঁচজন জঙ্গিকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরের বিশেষ জজ আদালত। রায়ে একজন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আসামিদের সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য।
প্রায় ১৬ মাস ধরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতকাল মঙ্গলবার বিচারক আলোচিত ওই হত্যা মামলার রায় দেন। রাষ্ট্রপক্ষের ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত।
২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর দেশের রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে জাপানের নাগরিক কুনিও হোশিকে (৬৬) গুলি করে হত্যা করা হয়।
এর মাত্র পাঁচ দিন আগে ঢাকায় একইভাবে ইতালির নাগরিক চেজারে তাভেল্লাকে খুন করা হয়। একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ড বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেক দেশ নিজ নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরে রেড অ্যালার্ট জারি করে।
দেশকে অস্থিতিশীল এবং অর্থনীতিকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে কুনিও হোশিকে হত্যা করা হয়েছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে আদালত।
বিদেশি নাগরিক হত্যার এ রায়কে ইতিবাচক বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। অপেক্ষাকৃত কম সময়ে হওয়া তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় এ দেশের নিরাপত্তা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি বিদেশিদের আস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার বিষয়টির সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। সে জন্য এর তদন্ত ও বিচার খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে। এর ফলে বিদেশিরা অবশ্যই কিছুটা আশ্বস্ত হবে।”
তিনি বলেন, “ঘটনার তদন্ত হচ্ছে, আসামিরা ধরা পড়ছে, দ্রুত বিচার হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এগুলো বিদেশিদের অবশ্যই ইতিবাচক বার্তা দেয়।”
তবে বিদেশিদের এই আস্থা ফেরানো শুধু বিচার প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।
তিনি বেনারকে বলেন, “এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা, বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের কাজের পরিবেশ থাকা, নিজেদের নিরাপদ মনে করা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে।”
গত ৩ জুলাই আটজনকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পুলিশ। এদের মধ্যে দুজন আগেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। রায়ের সময় বাকি ছয় আসামির পাঁচজন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন; জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), একই সংগঠনের সদস্য লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), ইছহাক আলী (৩৪), সাখাওয়াত হোসেন (৩০) এবং পলাতক আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব (২৪)।
হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ না হওয়ায় আটক থাকা আরেক আসামি আবু সাঈদকে (২৮) খালাস দিয়েছে আদালত।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক সাংবাদিকদের বলেন, “তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাঈদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে জানান আদালত। এ কারণেই তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তবে নথিপত্র পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে আপিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বিএনপি নেতাকে ঘিরে তদন্ত শুরু, জঙ্গিতে শেষ
দুই একর জমি ইজারা নিয়ে রংপুরের আলুটারি গ্রামে কুনিও হোশি ঘাসের আবাদ করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে এক ব্যক্তির রিকশায় চড়ে নিজের খামার দেখাশোনার কাজে যেতেন তিনি। ঘটনার দিনও একইভাবে খামারে যাওয়ার পথে খুন হন জাপানের এই নাগরিক। যিনি বাংলাদেশে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন বলে পরে জানা যায়।
সেসময় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই বিদেশিকে হত্যার দায় স্বীকার করেছিল। তবে সরকার তা নাকচ করে দেয়।
কুনিও নিহত হওয়ার দিনই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম।
শুরুর দিকে পুলিশের তদন্তে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার নাম খুঁজে পায় পুলিশ। তবে পরে দেশীয় জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পান তাঁরা। এভাবেই একে একে ছয় আসামিকে আটক করা হয়।
গত বছর ৩ জুলাই রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রেও এসব বিএনপি নেতার নাম ছিল না। ফলে রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লব, রংপুর মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান সুমন, বিজয় দাশ, নওশাদ হোসেন রুবেল, রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রিপাড়ার কাজল চন্দ্র বর্মণ এবং কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ূন কবির হীরা কুনিও হত্যা অভিযোগ থেকে অব্যহতি পান।
এভাবে যেকোনো ঘটনার শুরুতে রাজনৈতিক রং মেশানোর ফলে যেকোনো মামলার তদন্তকাজ জটিল হয়ে যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “যেকোনো কিছু ঘটলে এটাকে রাজনৈতিক রং দিলে এসব বিচার ও তদন্ত কঠিন হয়ে যায়। এ মামলার ক্ষেত্রেও অনেকগুলো লোককে সন্দেহের বসে আটক করা হয়েছিল। তবে আশার কথা হলো—আমাদের তদন্তকারীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে না। এ মামলা তার প্রমাণ।”
আস্থার পরিবেশে ফিরেছে
একের পর এক ব্লগার ও বিদেশি নাগরিক হত্যা থেকে শুরু করে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “ ২০১৩ সাল থেকে ব্লগার, লেখক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, বিদেশি নাগরিক হত্যা হলেও হলি আর্টিজেনে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অভিযান শুরু করে। এরপর জনগণ, বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা ভয়ভীতি, শঙ্কা কেটে আস্থার পরিবেশে ফিরে আসে। এ জন্য সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধুবাদ পেতে পারে।”
এই বিচারের মাধ্যমেও বাংলাদেশের প্রতি জাপান সরকারের আস্থা ফিরিয়ে আসবে বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশ্লেষক।