বিকল্প পথে মানবপাচার অব্যাহত, বাংলাদেশিদের বিষয়ে কঠোর হচ্ছে মালয়েশিয়া

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.12.21
স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে আটক ৩১ জন ইন্দোনেশিয়ান ও বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে আটক ৩১ জন ইন্দোনেশিয়ান ও বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী। জহর, মালয়েশিয়া। ২১ ডিসেম্বর ২০১৬।
মালয়েশিয়া পুলিশের সৌজন্যে

উন্নত জীবন আর বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় পাচারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে মানবপাচারকারী চক্রগুলো। বাংলাদেশ থেকে আপাতত নৌপথে মানব পাচার বন্ধ থাকলেও আকাশ পথে কখনো ছাত্র কখনো বা পর্যটক সাজিয়ে শ্রমিকদের পাচার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্য দেশের বিমানবন্দরও ব্যবহার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি এভাবে পাচারের শিকার বেশ কয়েকজন শ্রমিককে উদ্ধারের পর, বাংলাদেশিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু কঠিন শর্ত আরোপ করেছে মালয়েশিয়া।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। প্রচুর বাংলাদেশি পর্যটকও প্রতিবছর দেশটিতে ভিড় জমান।

কঠোর নজরদারির মাধ্যমে এখনই মানবপাচার বন্ধ করা না গেলে বিষয়টি শ্রম বাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি সাধারণ পর্যটকদের ভ্রমণেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

দুই দিন ৬১ বাংলাদেশি উদ্ধার

বাংলাদেশ থেকে আপাতত নৌপথে মানব পাচার বন্ধ থাকলেও ইন্দোনেশিয়া হয়ে নৌপথে অনেকেই মালয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করছে।

দেশটির বিভিন্ন এলাকা থেকে গত দুই দিনে ৬১জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ।

সোমবার ভোরে রাজধানী কুয়ালালামপুরের ডেসা পতালিং এলাকার দুটি বাসায় অভিযান চালিয়ে পাচারকারীদের হাতে আটক ৫৯ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে দেশটির পুলিশ। এ ছাড়া মানবপাচার চক্রের সন্দেহভাজন হিসেবে নারীসহ আরো তিন বাংলাদেশিকেও আটক করা হয়। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।

“এই চার বাংলাদেশিকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মানবপাচার আইনের অধীনে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তও করা হবে। এ ছাড়া উদ্ধার হওয়া অন্যান্য বাংলাদেশিদের ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে।” বেনারকে জানান দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তফার আলি।

তিনি বলেন, “নতুন কৌশল হিসেবে পাচারকারীরা মালয়েশিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্দোনেশিয়াকে ব্যবহার করছে।”

দেশটির গণমাধ্যমগুলো বলছে, নিজেদের চাকরিদাতার এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে পাচারকারিরা শ্রমিকদের বাংলাদেশ থেকে প্রথমে জাকার্তায় পাচার করে। সেখান থেকে স্থানীয় দালালরা টাকার বিনিময়ে তাদেরকে নৌপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা করে।

পত্রিকাগুলোর খবরে আরো বলা হয়, পাচারের শিকার হওয়া বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়ায় আসার পর দুটি ফ্লাটে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকে কেউ পালানোর চেষ্টা করলে মারধর করত পাচারকারীরা।

এ দিকে বুধবার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া প্রবেশের সময় সমুদ্র সৈকত থেকে আরো দুই বাংলাদেশিসহ ৩১ জনকে আটক করেছে দেশটির মেরিন পুলিশ। চারজন নারীসহ বাকি ২৯জন ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক। এদের সকলের বয়স ২০-৫০ বছরের মধ্যে।

এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া মেরিন পুলিশের আঞ্চলিক কমান্ডার পল হিউ খুন চিয়াং বেনারকে বলেন, “বুধবার ভোরে ৩১ জন বাংলাদেশি ও ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক অবৈধ পথে মালয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় মেরিন পুলিশ তাদেরকে সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে আটক করে।”

পুলিশ এসব পাচারের সঙ্গে জড়িত হোতাদের আটক করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে তিনি জানান।

কঠোর মালয়েশিয়া

একের পর এক অবৈধ বাংলাদেশি আটক হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ।

মানবপাচার কমাতে মালয়েশিয়া ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের উপর কিছু নীতিমালা আরোপ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন প্রধান বেনারকে বলেন, “পর্যাপ্ত আর্থিক সঙ্গতি, থাকার ব্যবস্থা বা হোটেল বুকিং এবং ফিরতি টিকিট না থাকলে কোনো  বাংলাদেশিকে কুয়ালালামপুরের বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। বেশ কিছু লোককে ফেরতও পাঠানো হয়েছে।”

দায় সরকারের

এদিকে অবৈধভাবে যাওয়ার দায় বাংলাদেশ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “প্রতি নিয়তই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি আটক হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, ছাত্র কিংবা পর্যটক সাজিয়ে মানব পাচার চলছে। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ পর্যটক অথবা একজন বয়স্ক পুরুষ ছাত্র সেজে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের চোখের সামনে এসব ঘটলেও তারা চোখ বন্ধ করে থাকেন।”

মানবপাচারের এই দায় সরকারের জানিয়ে তিনি বলেন, “সংশ্লিষ্ট বিভাগটিকে এই বিষয়ে অনেক অনুরোধ জানানো হলেও লাভ হয়নি।”

তাঁর মতে, “দেশের শ্রম বাজার রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খুব শিগগিরই জিটুজি প্লাসের আওতায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া শুরু করবে মালয়েশিয়া।

তবে এসব অবৈধ পথে যাওয়া শ্রমিকদের দেশে ফেরত এনে বৈধ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের প্রতি নজর দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা অভিবাসী শ্রমিক সংস্থার পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “যারা অবৈধ পথে বিদেশ যাবে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কোনোভাবেই তাদেরকে নিয়মিত শ্রমিক করা যাবে না। এতে করে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার পরিমাণ বাড়বে।”

প্রতিবেদনটিতে মালয়েশিয়া থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন হাতা ওহারি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।