পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণ ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, বেকায়দায় সরকার
2017.02.06
জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের সাফল্যে ভর করে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। এখন সেই আন্দোলনের মুখেই পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
সরকারি কাজে অধিগ্রহণ করা ফসলি জমি ফেরত পেতে এখন গ্রামে গ্রামে সংগঠিত হচ্ছে কৃষকরা। অবরোধের মুখে অসহায় হয়ে পড়ছে পুলিশও।
সম্প্রতি রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গড়, বীরভূমের বোলপুর, বর্ধমানের অন্ডাল ও পানাগড়ে জমিহারা কৃষকেরা তাঁদের জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন।
গত ১৮ জানুয়ারি ভাঙ্গড়ে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভে সময় ৪টি পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশের গুলিতে মারা যান দুইজন আন্দোলনকারী। গ্রামবাসীর লাঠি, ইট-পাটকেল ও ধারালো অস্ত্রসহ প্রতিরোধের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয় পুলিশ।
গ্রামবাসীদের জমি ফেরত পাওয়ার আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে সিপিআইএম, কংগ্রেস, পিডিএসের মতো রাজনৈতিক দলও।
জোর করে জমি নেওয়া হবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ঘোষণা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গড়ের দশ-বারোটি গ্রামের ১৩ দশমিক ৬ একর জমি জোর করে কেনা হয়।
সেখানে ২২৫ কোটি রুপি ব্যয়ে বিদ্যুতের সাব-স্টেশন তৈরির জন্য পাওয়ার গ্রিড করপোরেশনের কাজও এগিয়ে গেছে। এই সাব-স্টেশন তৈরি হলে রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা অতিরিক্ত ৩ হাজার মেগাওয়াট বাড়বে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছিল।
সেসময় বহু ফসলি জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার প্রতিবাদ জানাতে না পারলেও কৃষকেরা এখন সংগঠিত হয়েছেন। আর এই সাব-স্টেশন থেকে বহু কৃষকের জমির ওপর দিয়ে হাইটেনশন লাইন যাওয়ার ফলে কৃষি, এমনকি শারীরিক ও পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় প্রকল্প বাতিল করে জমি ফেরত দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন গ্রামবাসীরা।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চলছে
আট বছর আগে নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গড়ার ধাঁচেই সিপিআই (এমএল) রেড স্টার দলের নেতাদের যুক্ত করে গত নভেম্বর থেকে গ্রামবাসীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়।
গত ২ ডিসেম্বর ১০-১২টি গ্রামের মানুষ মিলে ‘জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি’ তৈরির পরে নানা স্তরে আন্দোলন শুরু করে। ভাঙ্গড়ের কমিটির মুখপাত্র হয়েছেন রেড স্টার নেতা অলীক চক্রবর্তী। প্রকল্পের লাগোয়া সব গ্রামে তৈরি করা হয় শাখা কমিটি।
এ সম্পর্কে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আলি মহম্মদ মল্লিক বেনারকে বলেন, “আগে আমরা সংগঠিত হতে পারিনি। কমিটি তৈরি হওয়ার পর মানুষকে সংগঠিত করার কাজ সহজ হয়েছে।”
এদিকে বহিরাগত হিসেবে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী আর মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ভাঙ্গড়ের সাধারণ মানুষকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে আন্দোলনে অংশ নেওয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ত্রিদিবেশ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “স্থানীয়দের ন্যায়সংগত আন্দোলনের পাশে অন্যদের দাঁড়ানোয় কোনো অন্যায় নেই।”
আর রেড স্টার নেতা অলীক চক্রবর্তী বলেন, “মাওবাদী আখ্যা দেওয়া হলেও, আমরা একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল। তাই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্যে কোনো বাঁধা নেই। তবুও আমাদের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
যেভাবে জমি আন্দোলনের শুরু
বামফ্রন্ট সরকার প্রথম নন্দীগ্রামে একটি কেমিক্যাল হাব তৈরির জন্য ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনের বলে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের নির্দেশ জারি করেছিল। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো মোটর গাড়ি কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়। মমতার আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালে কাজ বন্ধ করে চলে যেতে বাধ্য হয় টাটা।
ওই আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ আমলের আইন বাতিল করে ‘ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও স্বচ্ছতা বজায় রেখেই জমি অধিগ্রহণ’ যুক্ত করে ২০১৩ সালে ভারতে নতুন জমি আইন তৈরি হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, ওই আন্দোলনের জোরেই ৩৪ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরে যেতে বাধ্য হয় এবং মমতা ক্ষমতায় যান।
পরে মমতার মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিঙ্গুরের জমি কৃষকদের ফেরত দিতে বিধানসভায় আইনও পাশ হয়েছিল। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বামফ্রন্ট আমলের জমি অধিগ্রহণ বেআইনিভাবে হয়েছিল বলে রায় দেয়।
ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন
ভাঙ্গড়ের পর জমি আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বীরভূমের শিবপুর মৌজা। বোলপুর থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরের এই শিবপুরের ৩০০ একর জমির ওপরেই গীতবিতান থিমসিটি ও বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এই সিদ্ধান্তে নতুন করে কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এলাকা।
গত ৩০ জানুয়ারি গ্রামবাসীরা অধিগৃহীত জমির পাঁচিল ভাঙচুর করেছে, আগুনও দিয়েছে কয়েকটি জায়গায়।
স্থানীয় গ্রামবাসী শেখ রফিক বেনার নিউজকে বলেছেন, “আমরা টাউনশিপ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দেইনি। আমরা ভেবেছিলাম শিল্প হলে কাজ পাব। কিন্তু কিছুই হয়নি।”
গত ১৭ বছরে জমির দাম অনেক বেড়েছে। সেই হারে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে দাবি তাঁর।
ওদিকে বর্ধমানের অন্ডালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অধিগৃহীত হাজার একরের বেশি জমির জন্য সকলকে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে গ্রামবাসী।
পানাগড়েও শিল্প তালুক তৈরির জন্য ২০০৮ সালে অধিগৃহীত জমি কৃষকেরা ফেরতের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।
জমি অধিগ্রহণ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে জমির চরিত্রই অন্যরকম। এখানে জমি ছোট ছোট আয়তনে বিভক্ত। প্রায় সব জমিতেই একাধিক ফসলের চাষ হয়।
তিনি বলেন, জোর করে জমি নেওয়া হবে না—সরকারের এই ঘোষণার পরে শিল্পের জন্যই হোক, বা এলাকা উন্নয়নের জন্য হোক জমি পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। আর তাই রাস্তা সম্প্রসারণের মতো কাজও আটকে যাচ্ছে।
যেসব জায়গায় এখন পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে সেসব জায়গায় জমির মালিকদের প্রায় সবাই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। ভাঙ্গড়ে তাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে পাঠানো হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ ধর্মীয় নেতা পীরজাদা কশেম সিদ্দিকিকে। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণের বিষয়টিই এখন স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠেছে ।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বেনারকে জানান, “আমরা জোর করে জমি নেওয়ার বিরোধী। তাই ভাঙ্গড়ের মানুষ না চাইলে সরকার অন্য ভাবনা ভাববে।”