মানব অঙ্গের অবৈধ ব্যবসা রোধে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন অনুমোদন

জেসমিন পাপড়ি
2017.07.17
ঢাকা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন-২০১৭’ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন-২০১৭’ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। জুলাই ১৭, ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

চিকিৎসা সেবা আরও বিস্তৃত করা এবং মানব অঙ্গ পাচার বন্ধ ও এর অবৈধ ব্যবসা রোধে মানব দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ২০১৭-র এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রীসভা।

নতুন এই আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে আত্মীয়ের পরিধি বাড়িয়েছে সরকার। এখন আপন নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি, আপন চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো-খালাতো ভাই-বোনেরাও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করার সুযোগ পাবে। এমনকি মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গও অন্যের শরীরে সংযোজন করা যাবে।

সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া মানব দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ২০১৭-র খসড়াতে এসব কথা বলা হয়েছে।

তবে নতুন এ আইনে আত্মীয়ের মিথ্যা তথ্য দেওয়াসহ আইন ভঙ্গের অপরাধে সাজার মেয়াদ কিছুটা কমানো হলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণের আওতা বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে অঙ্গের অভাবে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসবে বলে মনে করেন তাঁরা।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বেনারকে বলেন, “নিঃসন্দেহে এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। আইন না থাকায় বহু মানুষ চাইলেও স্বজনের অঙ্গ নিতে পারছে না। আশা করি এই সংকট এবার কমবে।”

আইনটি কার্যকর হলে অঙ্গ সংস্থাপনের জন্য রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়া কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আইনে কেবলমাত্র পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং রক্ত-সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা—এই ১২ জন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারেন।

প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলতে কিডনি, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অন্ত্র, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম, টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বোঝানো হয়েছে। সুস্থ ও স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির চোখ ছাড়া অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিযুক্তির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকলে তিনি নিকটাত্মীয়কে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। কেবলমাত্র চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন ও প্রতিস্থাপনে নিকটাত্মীয় হওয়ার প্রয়োজন হবে না।

মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদের অতিরিক্ত সচিব আশরাফ শামীম সাংবাদিকদের বলেন, “খসড়া আইনে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন বলতে বাবা মা, সন্তান, ভাই, বোন, নাতি নাতনি, স্বামী স্ত্রী এবং রক্তের সম্পর্কীয় দাদা, নানা, মামা, চাচা, খালু, ফুপা, মামি, চাচি ও ফুপুর মতো আত্বীয়-স্বজনদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।”

জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করলে ওই ব্যক্তির ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণার পর আইনানুগ উত্তরাধিকারী লিখিতভাবে অনুমতি দিলে সংযোজনের জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিযুক্ত করা যাবে। তবে ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো দাবিদার না থাকলে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পালনকারী ব্যক্তি অনুমতি দিতে পারবেন।

আইনে ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তির বয়স দুই বছরের কম অথবা ৬৫ বছরের বেশি হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না বলা হয়েছে। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন বা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

এ ছাড়া জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম অথবা ৬৫ বছরের বেশি হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না। তবে পুনঃ উৎপাদনশীল টিস্যুর ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা রক্ত-সম্পর্কিত ভাই বা বোন হলে অথবা চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন বা প্রতিস্থাপনে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

আশরাফ শামীমের মতে, “চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন এবং মানব অঙ্গ পাচার বন্ধ ও এর অবৈধ ব্যবসা রোধে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।”

হাসপাতালগুলোর জন্য নির্দেশনা

নতুন আইন অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালগুলো সরকারের কোনো অনুমোদন ছাড়াই মানব দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পারবে। তবে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল সরকারের অনুমোদন ছাড়া মানব শরীরের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।

মন্ত্রিপরিষদের অতিরিক্ত সচিব বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য এই আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে।”

তিনি জানান, একজন নিউরোলজিস্ট, এনেস্থেসিয়োলজিস্ট এবং একজন মেডিসিন অথবা ক্রিটিক্যাল বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে প্রতিটি হাসপাতালে তিন সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে এবং তারা অধ্যাপক অথবা কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক হবেন।

আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘোষণা দানকারি কোনো ব্যক্তির কোনো আত্মীয়-স্বজনের এই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হবাব ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি কারডিয়াক কমিটি গঠন করতে হবে। মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের গোটা বিষয়টি দেখভাল পরামর্শ দেবে এই কমিটি।
রয়েছে সাজার ব্যবস্থা

প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অঙ্গদাতা ও গ্রহীতা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলে বা এতে কাউকে উৎসাহিত বা প্ররোচিত বা ভীতি প্রদর্শন করলে তার সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বাধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এ আইনের অন্যান্য ধারা অমান্য বা এ বিষয়ে কাউকে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বাধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে। এই আইনে দোষী সাব্যস্ত যেকোনো চিকিৎসকের বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আইনের কোনো ধারা লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ড বা সর্বাধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।