সম্পদ ধ্বংস রোধে পশ্চিমবঙ্গে সম্পত্তি ক্রোক করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের আইন

কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল
2017.02.22
পশ্চিমবঙ্গের ধুলাগড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। পশ্চিমবঙ্গের ধুলাগড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬।
বেনার নিউজ

আন্দোলনের নামে সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করলে শাস্তির পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান রেখে আইন পাশ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

আগের আইনে জেল-জরিমানার কথা থাকলেও এবার ক্ষতিপূরণ আদায়ে আন্দোলনকারীদের সম্পত্তি ক্রোক করারও বিধান রাখা হয়েছে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ নতুন আইনটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পেশ করলে বিরোধীরা প্রবল আপত্তি জানায়। পরে বিরোধী শূন্য বিধানসভায় বিলটি পাশ হয়।

নতুন এই আইন দাঙ্গাকারী ও হামলাকারীদের স্তব্ধ করবে বলে বিধানসভায় জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টও তৈরি করা হবে বলেও জানান তিনি।

আইনটির পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অরূপ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “সরকারের বা মানুষের সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও যারা বলবে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে।”

বিরোধীরা অবশ্য এই আইনকে ‘কালা কানুন’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিবাদ আন্দোলনের কণ্ঠ রোধ করতেই এ আইন এনেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

“নতুন আইনে আন্দোলনকারীদের দুষ্কৃতি বা সমাজবিরোধীর তকমা দেওয়া হয়েছে,” বেনারকে বলেন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক দুলাল বর।

কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কেশব ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “এ আইনের ‘কালেকটিভ কমপেনসেশনের’ যে ধারাটি রাখা হয়েছে তা সংবিধানের ১৯ ধারা অনুযায়ী বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।”

এই আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। রাজ্যের গভর্নর কেশরী নাথ ত্রিপাটির কাছে নালিশও জানিয়েছেন বিরোধীরা।

কী রয়েছে নতুন আইনে

১৯৭২ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল মেইনটেন্যান্স অব পাবলিক অর্ডার আইনে সংশোধনী এনে নতুন যে আইনটি করা হয়েছে তাতে শাস্তির পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আদায়ের সংস্থান যুক্ত করা হয়েছে।

সরকারি সম্পত্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতিও নতুন আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ক্ষতির জন্য জরিমানার অঙ্ক নির্ধারণ করা হবে সম্পত্তির বাজার মূল্যের ভিত্তিতে।

আইন অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ দিতে না পারলে সম্পত্তি ক্রোক করে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করা হবে। আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের পদাধিকারীদের সম্পত্তিও ক্রোক করা হবে।

আগের আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি যে সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী, তার স্বপক্ষে পুলিশকে প্রমাণ দাখিল করতে হতো। কিন্তু নতুন আইনে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে, সে সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী নয়।

আন্দোলনের নামে সম্পত্তি ধ্বংস

সম্প্রতি কলকাতার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। এর ফলে সিএমআরআই হাসপাতালে ক্ষতি হয়েছে কয়েক লক্ষ রুপির সম্পত্তি।

বর্ধমানের আউশ গ্রামে পুলিশ স্টেশনে ভাঙচুর এবং পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গড়েও চারটি পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরানো হয় এবং কয়েকটি গাড়িকে জলে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

এই সব ঘটনা মানা হবে না বলে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে বিক্ষোভের নামে ভাঙচুর তথা নেতিবাচক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলায় ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও -এর ট্রাডিশান খতম করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তিনি।

“কোনো একটা ঘটনা ঘটল, অমনি দুটো পুলিশের জিপ জ্বালিয়ে দিয়ে এলো। দুটো সাধারণ মানুষের বাড়িতে আগুন দিয়ে দিলো। এসব চলবে না। সরকার এ সবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে,” বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কেরা ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর ভাঙচুরের পর ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা পরিদর্শন করছেন দর্শনার্থীরা। ডিসেম্বর ০১, ২০০৬।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কেরা ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর ভাঙচুরের পর ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা পরিদর্শন করছেন দর্শনার্থীরা। ডিসেম্বর ০১, ২০০৬।
AFP
তবে বিরোধীদের অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন তিনি নিয়মিত ভাঙচুরে মদদ দিয়েছেন।

অতীত উদাহরণ টেনে সিপিআইএমের পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদদে যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কেরা ভাঙচুর করেছিলেন তার কোনো নজির ছিল না।”

ভারত সরকারও চায় সম্পত্তি ধ্বংস ঠেকাতে

সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে টি টমাসের নেতৃত্বে একটি কমিটি সম্পত্তি ধ্বংস ঠেকাতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট টমাস কমিটির সুপারিশ মেনে নিয়ে নির্দেশও জারি করেছিল। ওই সুপারিশে সরকারি সম্পত্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতির কথাও বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ আদায়েরও বিধান রয়েছে। জামিনের আবেদনকারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের সমান সিকিউরিটি হিসেবে অর্থ আদায়ের কথাও বলা হয়েছে।

সেই সুপারিশের ভিত্তিতে ভারত সরকার ১৯৮৪ সালের প্রিভেনশন অব ড্যামেজ টু পাবলিক প্রোপার্টি আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।

এর পরেই ভারত সরকার রাজ্যগুলোকে টমাস কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নিজের মতো করে আইন করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

তবে বিচারপতি টমাস টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, “কেরালা হাইকোর্টের বিচারক কে টি শঙ্করণ তাঁর সুপারিশগুলো এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে বিতরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, ক্ষতিপূরণের সমান অর্থ জমা না দিলে যেন জামিন দেওয়া না হয়।”

এর ফলে কেরালা রাজ্যে ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিচারপতি টমাসের মতে, “কলকাতা হাইকোর্টও সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদিত নির্দেশ গুলো ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে বিতরণ করার ব্যবস্থা করুক।”

সেই সঙ্গে পুলিশ যাতে সম্পত্তি ধ্বংসের ভিডিওগ্রাফি তোলার ব্যবস্থা করে সে কথাও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।