জুলহাজ-তনয় হত্যার তদন্ত দুই বছরেও শেষ হয়নি
2018.04.24
ঢাকা
যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে সক্রিয় ‘এলজিবিটি অ্যাকটিভিস্ট’ জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দুই বছরেও শেষ হয়নি। রাজধানীর কলাবাগানে জুলহাজের বাসায় ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল খুন হন তাঁরা।
ঢাকার অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার আনিসুর রহমান মঙ্গলবার রাতে বেনারকে জানান, এ সংক্রান্ত দুটি মামলার চার্জশিট দাখিলের জন্য পুলিশকে আগামী ২০ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছে আদালত।
“এটা এভাবে ঝুলতে থাকবে। জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের বিচার এই দেশে কখনো হবে না,” দাবি করে নিহত জুলহাজের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, “সরকার আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝি দিয়েছে, আমরা জড়িতদের মেরে ফেলেছি।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনও বেনারকে বলেন, “জুলহাজ-তনয়সহ ওই সময়ে জঙ্গিদের দ্বারা সংগঠিত হত্যাকাণ্ডগুলোয় জড়িতদের অধিকাংশই কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারে নিহত, কিংবা গুম হয়েছে। এটা তদন্ত বিঘ্নিত হওয়ার অন্যতম কারণ।”
সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে কাজ করতেন। তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র তনয় পেশায় ছিলেন নাট্যকর্মী। তিনি লোক নাট্যদল এবং তাদের শিশু সংগঠন পিপলস থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশের প্রথম সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা ‘রূপবান’ প্রকাশ ও প্রচারের সাথে জড়িত ছিলেন তাঁরা। হত্যাকাণ্ডের পর জুলহাজের ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন ও পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শামীম বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, “পার্সেল ডেলিভারির কথা বলে কয়েকজন যুবক বাসায় ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা করে। জুলহাজের মরদেহ বেডরুমে এবং তনয়ের মরদেহ ড্রয়িংরুমে পাওয়া যায়।”
“তাঁদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরায় পাঁচজনের পালিয়ে যাওয়ায় ফুটেজ পাওয়া গেছে,” বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে
পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বেনারকে জানান, গত ১৫ এপ্রিল এ সংক্রান্ত মামলা দুটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল।
“তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক বাহাউদ্দিন ফারুকী ও নুরুল আফসার প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা আক্তার নতুন করে দিন ধার্য করেন,” বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, এই জোড়া খুনের মামলায় রাশিদুল নবী ও শরিফুল ইসলাম ওরফে শিহাব নামের দুজন আসামি কারাগারে আছেন।
কলাবাগান লেক সার্কাস লাল ফকিরের মাজার এলাকার ৩৫ নম্বর বাসা আছিয়া নিবাসের দ্বিতীয় তলায় খুন হন জুলহাজ ও তনয়।
“জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই। তিনি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক যুগ্ম সচিব এম এ মান্নানের ছেলে,” জানান তাঁর অগ্রজ মিনহাজ।
তিনি বেনারকে বলেন, “এই ঘটনার বিচার করার আদৌ কোনো ইচ্ছে বা আগ্রহ সরকারের আছে বলে মনে হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রুটিন ওয়ার্ক করছে।”
“রাষ্ট্র যদি বিচার না করে তাহলে আমরা অসহায়। কিছুই করার নেই,” জানিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশের কাছে যদি জিজ্ঞেস করতে যাই যে কেন এখনো তদন্ত শেষ হয়নি, তবে তারা যদি বলে আমি সরকারকে বিব্রত করতে চাচ্ছি; সেই ভয়ে যাচ্ছি না।”
মিনহাজ বলেন, “জুলহাজ এক নতুন আন্দোলনের পথিকৃৎ। তবে তার কাজটা অসময়োচিত। সমাজ প্রস্তুত ছিল না। ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় সে এই আন্দোলনটা করেছে।”
তিনি বলেন, “হিজড়া ও সমকামীদের সাথে তার সখ্যতাও পরিবারের কেউ ঠিক মতো মেনে নেইনি। এ কারণে ছোটবেলা থেকেই সে অনেক মানসিক চাপে ছিল। কিন্তু এর জন্য তার দায় নেই।”
“সে জন্মগতভাবেই সমকামী। বিভিন্ন উন্নত দেশের মানুষ এখন বুঝতেছে এটা জন্মগত সমস্যা,” যোগ করেন জুলহাজের ভাই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “জুলহাজ-তনয়ের পরিবারে পাশে কেউ নেই, কারণ সমকামীদের ব্যাপারে এ দেশে এক ধরনের সামাজিক অবহেলা রয়েছে।”
“মূলত ভিন্নভাবে জীবনযাপনকারীদের সাথে সমাজের সাধারণ স্রোতধারার একটা ‘গ্যাপ’ রয়েছে। এ কারণে ভিন্নভাবে যারা জীবনযাপন করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আমাদের সমাজের মানুষেরা সাহসী ভূমিকা নিতে পারে না,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী।
মিনহাজের অভিমত, “এই (এলজিবিটি) ইস্যুর পাশে কেউ দাঁড়াবে না। মৃত্যু ভয়ে এই ইস্যুকে কেউ ওউন করবে না।” সামাজিক চাপ এড়াতে জুলহাজের পরিবার তার মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো আয়োজন করবে না বলেও তিনি বেনারকে জানান।