জুলহাজ–তনয় হত্যা: সমকামীদের সামাজিক আন্দোলন সংকুচিত, রায় ঘোষণার প্রস্তুতি
2021.04.27
ঢাকা
পাঁচ বছর আগে জঙ্গি গোষ্ঠী আনসার আল-ইসলামের হাতে নিজ বাসায় জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যার পর বাংলাদেশে সমকামীদের (এলজিবিটি) অধিকার প্রতিষ্ঠার সামাজিক আন্দোলন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল চাপাতির আঘাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত সমকামীদের প্রথম ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান।
তাঁরই নেতৃত্বে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো তাঁদের রংধনু পতাকাসহ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দেন সমকামীরা।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পার হলেও বিচারের রায় এখন পর্যন্ত ঘোষণা হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে জুলহাজের অবদানকে স্মরণ করে বিবৃতি দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
তবে জুলহাজ মান্নানের মা এখনও জানেন না তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।
জুলহাজের বড়ো ভাই মিনহাজ মান্নান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমি মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছি। আমি চাই এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার হোক। প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হোক।”
মিনহাজ বলেন, “কষ্ট হয় আমার মাকে নিয়ে। তাঁর বয়স প্রায় ৮৪ বছর। ডিমেনশিয়ার রোগী। তিনি সুন্দরভাবে চলাচল করতে পারেন, তবে সবকিছু মনে রাখতে পারেন না।”
“মা প্রায়ই জুলহাজের কথা জিজ্ঞেস করেন। বলেন জুলহাজ কোথায়? আমরা বলি সে আমেরিকা আছে। মিথ্যা বলি। সেও বিশ্বাস করে। কারণ আমার বোন ফ্লোরিডায় থাকেন,” জানান মিনহাজ।
তিনি বলেন, “মা যদি জানেন জুলহাজকে হত্যা করা হয়েছে তাহলে তাঁকে বাঁচানো যাবে না। তিনি ডিমেনশিয়ার রোগী হওয়ায় যা শোনেন, তা পরক্ষণে ভুলে যান।”
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় আনসার আল-ইসলামের কয়েকজন জঙ্গি কুরিয়ার সার্ভিসের লোক সেজে একটি বাকশো নিয়ে জুলহাজের কলাবাগানের বাসায় গিয়েছিল। তারা একটি বড়ো বাকশের মধ্যে চাপাতি ও অন্যান্য অস্ত্রসহ বাসায় প্রবেশ করে জুলহাজ ও তাঁর সহযোগী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
বাংলাদেশের সমাজ সমকামিতাকে ‘এখনও গ্রহণ করেনি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক ছাত্র জুলহাজ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে কাজ করতেন। পরে তিনি ইউএসএআইডি’র একটি প্রকল্পে কাজ শুরু করেন।
চাকরির পাশাপাশি বাংলাদেশের সমকামীদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রূপবান নামে বাংলাদেশে প্রথম একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন।
২০১৪ সালে তাঁর উদ্যোগেই সমকামীরা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে র্যালি বের করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সমকামীরা অনেকটা প্রকাশ্যে আসেন।
সন্ত্রাস বিরোধী আদালতের সরকারি কৌঁসুলি গোলাম সারোয়ার খান জাকির মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “জুলহাজ মান্নানকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা হত্যা করেছে। সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার কারণেই তাঁকে হত্যা করে জঙ্গিরা।”
পুলিশ এই জোড়া হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে ২০১৯ সালের জুলাই। ২০২০ সালের নভেম্বরে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়।
“মামলার শুনানি, যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। আদালত গত ৬ এপ্রিল রায় ঘোষণার তারিখ ঠিক করেছিলেন। তবে ৫ মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা করার কারণে মামলার রায় ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। লকডাউন উঠে গেলে রায়ের নতুন দিন ঠিক হবে বলে আশা করা যায়,” জানান গোলাম সারোয়ার।
এই মামলায় মোট আটজনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করার কথা জানান তিনি। আসামিরা হলেন: বরখাস্তকৃত মেজর জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, সাব্বিরুল হক চৌধুরী, জুনায়েদ আহমেদ ওরফে মওলানা জুনায়েদ আহমেদ ওরফে জুনায়েদ, মোজাম্মেল হোসেন সায়মন, আরাফাত রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ এবং আসাদুল্লাহ।
আসামিদের মধ্যে জিয়া, আকরাম, সাব্বিরুল ও জুনায়েদ পলাতক রয়েছেন।
সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কৃষ্ণচূড়ার প্রধান ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মিন (প্রকৃত নাম নয়) মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “সমকামিতাকে বাংলাদেশের সমাজ এখনও গ্রহণ করেনি।”
তিনি বলেন, সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু বেসরকারি সংগঠনের সহায়তায় বাংলাদেশের সমকামীরা ঢাকার গুলশান-বনানী ও কূটনৈতিক পাড়া কেন্দ্রিক কাজ করত।
“জুলহাজ মান্নান ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার বাইরে যেসব সমকামী রয়েছেন, তাঁদের একত্রিত করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি খুব ভালো সাড়া পাচ্ছিলেন,” জানান মিন।
তিনি বলেন, “জুলহাজ সমকামীদের অধিকার সম্পর্কিত রূপবান ম্যাগাজিন প্রকাশ করে সাড়া ফেলেছিলেন। জুলহাজ ও তনয় হত্যাকাণ্ডের পর সমকামীদের অধিকার সম্পর্কিত সামাজিক আন্দোলন অনেকটাই পিছিয়ে গেছে। অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।”
মিন বলেন, বাংলাদেশে কত সংখ্যক সমকামী আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশে হাজার হাজার সমকামী রয়েছেন, যাঁরা নিজেদের প্রকাশ করতে চান না।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্রান্সজেন্ডার বেনারনিউজকে জানান, “জুলহাজের মৃত্যুর আগে আমরা মোটামুটি খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারতাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে পারতাম। কিন্তু জুলহাজ-তনয়ের মৃত্যুর পর সব এলোমেলো হয়ে গেলো।”
“এখন আমরা অনুষ্ঠান করা তো দূরের কথা নিজেদের মধ্যেও ভালোভাবে কথা বলতে পারি না। আমাদের মধ্যে সমাজের এলিট কিছু মানুষ রয়েছে তাঁরা হয়তো বলতে পারে। কিন্তু আমরা পারি না,” জানান তিনি।
‘বাংলাদেশে সমকামিতা একটি অপরাধ’
এই জোড়া হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্তিতে ২৫ এপ্রিল বিবৃতি দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
তিনি বলেন, মানবাধিকার কর্মী জুলহাজ ও তাঁর সহযোগী মাহবুব রাব্বীকে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে সাহসী কাজের জন্য হত্যা করা হয়েছিল।
“এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্তিতে আমরা তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করবে এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁদের প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান জানাই,” বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বৈচিত্র্য, গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির নীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য জুলহাজের নিঃস্বার্থ উৎসর্গ বাংলাদেশে উৎকৃষ্ট কাজের উদাহরণ।
ব্লিনকেন আরও বলেন, “বাংলাদেশে তাঁর সম্প্রদায়ের পক্ষে নির্ভয় প্রচারণার প্রতি আমরা সম্মান জানাই এবং সারা বিশ্বে আত্মমর্যাদা ও মানবাধিকার রক্ষার প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি।”
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “জুলহাজ মান্নান হত্যাকারীদের বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে। সুতরাং, হত্যাকারীরা পার পাবে না।”
“বাংলাদেশ অন্যান্য নাগরিকদের মতো নাগরিক হিসাবে সমকামীদের সকল অধিকার সরকার রক্ষা করবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে, সমকামিতা উদ্বুদ্ধ করার কোনো চেষ্টা সরকার করতে পারে না। কারণ দণ্ডবিধি অনুযায়ী, বাংলাদেশের সমকামিতা একটি অপরাধ।”
“যতদিন আমাদের আইন পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না ততদিন আমরা সমকামিদের অধিকার রক্ষা বা বিকাশে কোনো কাজ করতে পারব না,” বলেন আইনমন্ত্রী।