বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার: দুই দেশের বিমানবন্দরে অভিবাসী কর্মীদের ভিড়
2024.05.30
ঢাকা ও কুয়ালালামপুর
![বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার: দুই দেশের বিমানবন্দরে অভিবাসী কর্মীদের ভিড় বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার: দুই দেশের বিমানবন্দরে অভিবাসী কর্মীদের ভিড়](https://www.benarnews.org/bengali/news/malaysia-05302024144722.html/@@images/178f2980-77d4-41df-9b6f-9f9e7e831a3b.jpeg)
বাংলাদেশের জন্য আবারও বন্ধ হয়ে গেছে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের চতুর্থ বৃহত্তম মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। করোনা অতিমারির পর পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মালয়েশিয়ার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম জানান, মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সর্বশেষ সময় ৩১ মে। এর পরে কাজের অনুমতি থাকলেও কোনো শ্রমিক প্রবেশ করতে পারবেন না।
এদিকে ভিসা পাওয়ার পরেও ফ্লাইট জটিলতায় অনিশ্চয়তায় পড়েছেন হাজারো মানুষ। উৎকণ্ঠায় শেষ মুহূর্তে ঢাকা ও কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে অভিবাসী কর্মীদের ভিড় দেখা গেছে।
তিন মাস অপেক্ষার পরে ভিসা পেলেও মালয়েশিয়ার টিকিট পাচ্ছিলেন না সিলেটের বাসিন্দা আল আমিন। শেষ মুহূর্তে চড়া দামে বিশেষ ফ্লাইটে বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ায় পৌঁছেন তিনি। তবে এখনো কুয়ালালামপুর বিমানবন্দের অপেক্ষা করছেন।
আল আমিন টেলিফোনে বেনারকে জানান, তাঁর মতো শত শত বাংলাদেশি বিমানবন্দরে আটকে আছেন। তাঁরা জানেন না কখন তাদের ইমিগ্রেশন হবে।
“ছয়-সাত ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও রিসিভ করার জন্য কোম্পানির কাউকে খুঁজে পাইনি,” বলেন তিনি।
গত ২৪ মে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া গেছেন মো. মিলন আহমেদ। তিনি বেনারকে বলেন, “৩০ হাজার টাকার একমুখী টিকিট ৯৫ হাজার টাকা দিয়ে কেটে এখানে এসেছি। অনেক বাংলাদেশি উল্টোপথে মানে দুবাই, কাতার, চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া হয়ে কুয়ালালামপুরে ঢুকেছে। ফলে এখানকার এয়ারপোর্টেও অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি প্রায় সাত ঘণ্টা এয়ারপোর্ট অপেক্ষা করার পর নিয়োগকর্তাকে খুঁজে পাই।”
ঢাকার অভিজ্ঞতা একই রকম ছিল বলে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক রুসলিন জুসোহ বলেছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার বিদেশি শ্রমিকদের আসে।
“তবে গত ২২ মে থেকে এই সংখ্যা বেড়ে প্রতিদিন অন্তত আড়াই হাজার এবং ২৭ মে থেকে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার জনে দাঁড়িয়েছে। ইমিগ্রেশন বিভাগ আশা করছে যে, এয়ারলাইনগুলো চাহিদা পূরণে ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াবে,” যোগ করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “অতিরিক্ত প্রায় ২০টি ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী মালয়েশিয়ায় আনা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “যারা মালয়েশিয়ায় আসার কাগজপত্র্র পেয়েছেন, তাদের বড় অংশ শুক্রবারের মধ্যে পৌঁছে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।”
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর বরাত দিয়ে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈকত চন্দ্র হালদার বেনারকে জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার বাজার উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত চার লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র নিয়েছেন। এদের বেশিরভাগ পৌঁছে গেছেন।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ হলে সেটার বড় প্রভাব বাংলাদেশের শ্রম বাজারে পড়বে। বছরে অন্তত এক লাখ কর্মী অভিবাসন কমে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশীয় শ্রমবাজারেও দেখা যাবে।”
শামীম আহসান বলেন, “মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হচ্ছে না। নানা কারণে তারা তাদের পলিসিগুলো পুনর্বিবেচনা করছে। আমাদের ধারণা, এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই তারা নতুন করে কর্মী নেবে।”
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, শুধু ২০২৩ সালেই সাড়ে তিন লাখের বেশি শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে মালয়েশিয়া।
সম্প্রতি, মালয়েশিয়া ২০২৫ সাল পর্যন্ত মোট শ্রমিকের ১৫ শতাংশ বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। অভিবাসন বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ২০ লাখ বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন।
সম্প্রতি কর্মীদের মানবাধিকার নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনার মুখে পড়েছে মালয়েশিয়া।
গত ২৮ মার্চ জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মালেয়িশয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের কাছে এক চিঠিতে তাঁরা বলেন, বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অপরাধী চক্রগুলো সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রগুলো প্রতারণার মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ভুয়া কোম্পানিতে শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়। ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ঋণের চক্রে আটকে পড়েন।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষের সঙ্গে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন পর্যন্ত জড়িত।
শ্রমিকদের ব্যাপক শোষণের অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশকে ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস জেনেভায় মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি নাদজিরাহ ওসমানের একটি চিঠি আপলোড করেছে।
গত ২৮ মে লেখা ওই চিঠিতে তিনি সরকারের পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, মালয়েশিয়া অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে এবং অপরাধমূলক নেটওয়ার্কের বিরোধিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ বিষয়ে হাজনাহ মো. হাশিম সাংবাদিকদের বলেন, “মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগে সক্রিয় সিন্ডিকেট দুই দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “একটি বিষয় সবার জানা যে, মালয়েশিয়ায় প্রচুর অবৈধ লোকজন বসবাস করছে। তাই মালয়েশিয়া সরকার দেশের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ এবং কর্মীদের নিরাপত্তা স্বার্থ বিবেচনা করে বিদেশি কর্মী সংক্রান্ত রিক্যালিব্রেশন প্রোগ্রাম নতুনভাবে সাজাচ্ছে।”
মালয়েশিায়ার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নর্থ-সাউথ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক আদ্রিয়ান পেরেইরা বেনারকে বলেন, “সরকার একটি কসমেটিক সমাধান দিয়েছে যা মূল সমস্যার সমাধান করবে না। দুর্নীতি, ভেঙে যাওয়া নিয়োগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ পর্যন্ত এসব সমস্যার মূলে রয়েছে।”
২০ বাংলাদেশি আটক
গত মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার জোহরে ২০ বাংলাদেশিসহ ৪৪ অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন বিভাগ। জোহরের মুয়ার শাখার এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি দল একটি লোহার কারখানা এবং মুয়ারের আশেপাশের বেশ কয়েকটি হটস্পটে অবস্থানসহ ১১টি প্রাঙ্গণে অভিযান চালিয়ে ৪৪ জনকে আটক করে।
এদের মধ্যে থাইল্যান্ডের ১৪ জন পুরুষ ও তিনজন নারী, বাংলাদেশের ২০ জন পুরুষ, চীনের তিনজন পুরুষ এবং ইন্দোনেশিয়ার একজন নারী রয়েছেন।