সাংসদদের তোপের মুখে গণমাধ্যম, আরও চাপে রাখতে চান কেউ কেউ

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.01.30
সাংবাদিকদের ওপর হামলা–মামলা ও হুমকির প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ। সাংবাদিকদের ওপর হামলা–মামলা ও হুমকির প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ। জানুয়ারি ৩০, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

চার সংসদ সদস্য অবৈধ মাদক ব্যবসায় জড়িত—এমন একটি প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের মত হচ্ছে, এর ফলে সাংসদদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। অভিযুক্ত সাংসদদের দাবি আমলে নিয়ে বিষয়টি সংসদের ‘বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে’ পাঠিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সাংবাদিক সমাজ। সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা ও হয়রানির ঘটনা বেড়েছে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আইন করার জন্য জাতীয় সংসদে দাবি তুলেছেন আইন প্রণেতারা।

সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উচ্চ পর্যায়ের সংসদীয় কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটির সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ অনেকেই।

অবজারভারের সেই প্রতিবেদন

‘মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় পুলিশ’ শিরোনামে গত ২৩ জানুয়ারি ইংরেজি দৈনিক অবজারভার একটি প্র​তিবেদন প্রকাশ করে। এতে চার সাংসদ এ কে এম শামীম ওসমান, নিজাম উদ্দিন হাজারি, এনামুল হক এবং আব্দুর রহমান বদি মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়।

পত্রিকার সংবাদ প্রকাশের কারণে সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে দাবি করে গত বৃহস্পতিবার কার্যপ্রণালী বিধির ১৬৬ ধারা অনুযায়ী সংসদে নোটিশ উত্থাপন করেন রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ এনামুল হক।

স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী নোটিশটি আমলে নিয়ে ভোটে দেন। সর্বসম্মতিক্রমে তা সংসদে পাস হয়। স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী এই কমিটির সভাপতি।

অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী একজন সাংবাদিক নেতা, তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংকেত ছাড়া স্পিকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এটা অনেকেই মনে করছেন না।

তোপের মুখে মিডিয়া

সংসদে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বক্তব্যের সূচনা করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সদস্য শামীম ওসমান।

গত বুধবার তিনি প্রথমে দেশের প্রথম সারির পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টা​র এবং এর দুই সম্পাদক মতিউর রহমান ও মাহ্‌ফুজ আনামের কঠোর সমালোচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ডেইলি অবজারভারের নাম উল্লেখ করে ওই পত্রিকাটিও আওয়ামী লীগের উদীয়মান নেতাদের চরিত্র হননে নেমেছে বলে অভিযোগ তোলেন।

শামীম ওসমান সংসদে বলেন, এই পত্রিকাগুলো হলুদ সাংবাদিকতা করছে। সম্প্রতি আততায়ীর গুলিতে নিহত সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যার জন্যও সাংবাদিকদের লেখনীকে দায়ী করেন ওই সাংসদ।

মৃত্যুর কয়েকমাস আগে লিটন একটি শিশুর ওপর গুলি বর্ষণ করায় সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

মানহানির মামলা

ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও পত্রিকাটির প্রতিবেদক মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে ১০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন ফেনী-২ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারি।

নিজাম হাজারি বেনারকে বলেন, “আমি সরকারের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছি।”

মানহানির মামলায় অভিযুক্ত সাংবাদিক মামুনুর রশীদ বেনারকে বলেছেন, “মাদক ব্যবসায় চার সাংসদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ হাতে পেয়েই তা লিখেছি।”

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা তার সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে মাদক বিরোধী ক্যাম্পেইনকে সহায়তা করতে চাই।”

মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “তাঁরা নিউজের প্রতিবাদ করেছিলেন। অবজারভারে তাদের সে বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তারপরও একদিকে তারা মামলা করছেন, অন্যদিকে সংসদে বিষোদ্‌গার করছেন। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত।”

সাংবাদিকদের প্রতিবাদ

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) সহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন সংসদে গণমাধ্যম, সম্পাদক ও শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে লাগামহীন বক্তব্য, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ ও হয়রানিমূলক কার্যক্রমের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বিএফইউজে সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেছেন, “জাতীয় সংসদে যাদের কথা বলার সুযোগ নেই তাদের সম্পর্কে তাদের অনুপস্থিতিতে এ রকম ঢালাও মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। এর মধ্য দিয়ে সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে।”

“কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কারও অভিযোগ থাকলে বিচারের জন্য প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারেন। কিন্তু দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য প্রদান অবশ্যই শিষ্টাচার বর্জিত আচরণ।”

সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ

প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। সাংবাদিক হত্যার বিচার নিয়ে সাংবাদিকসমাজ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন, কিন্তু মামলাগুলো শেষ হচ্ছে না।

এটিএন নিউজের রিপোর্টার কাজী ইহসান বিন দিদার ও ক্যামেরাপারসন আ. আলিম গত বৃহস্পতিবার তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালের খবর সংগ্রহের সময় পুলিশের নির্দয় পিটুনির শিকার হন।

সংবাদ পরিবেশনের কারণে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদাকে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে রাখা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

প্রেস কাউন্সিল যেভাবে দেখে

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “সংসদ সদস্যরা তাদের অধিকার ক্ষুণ্নের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সংবিধান সংসদে বক্তব্য প্রদানের বিষয়ে তাদের দায়মুক্তি দিয়েছে।”

চেয়ারম্যান আরও বলেন, “সংসদে দেওয়া সাংসদদের বক্তব্যের প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেই। আদালতেরও এ বিষয়ে রুলিং দেয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে পারি না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।