সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দশম

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.11.01
ঢাকা
সাংবাদিক উৎপল দাস এর সন্ধানের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সংবাদিকদের মানববন্ধন। সাংবাদিক উৎপল দাস এর সন্ধানের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সংবাদিকদের মানববন্ধন। ৩১ অক্টোবর ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

বিশ্বের যে কয়টি দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে দশম। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া।

৩১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি-টু-প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) প্রকাশিত সূচকে উল্লেখ করা হয়েছে যে গত এক দশকে সাতজন সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার হয়নি।

‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’ শিরোনামে প্রকাশিত সিপিজে সূচকে বলা হয়, বাংলাদেশে উগ্রবাদী ও অপরাধচক্রের সদস্যরা সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে হত্যা করেছে।

পূর্ব-পশ্চিম বিডি নামক অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিক উৎপল দাস নিখোঁজ হওয়ার ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে থাকা সাংবাদিকদের গাড়ি লক্ষ্য করে আক্রমণের পরপরই সিপিজে এই সূচক প্রকাশ করল।

সূচকে বলা হয়, গত বছর নভেম্বর মাসে পুলিশ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ব্লগার নিলয় নীল ও ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। নীল ও দীপন হত্যার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

সূচক অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত শুধু ২০১৩ সালে নিহত ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার বিচার কাজ শেষ হয়েছে।

সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংবাদিক হত্যা বা তাদের ওপর আক্রমণের কারণ মূলত রাজনৈতিক। এসব হত্যার বিচার না হওয়ার পেছনে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. শাহ আলমগীর বেনারকে বলেন, “সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ বা নির্যাতনের মূল কারণ রাজনৈতিক। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের কোনো ঘটনা ঘটলে বিরোধী দল সরকারের ওপর দোষ চাপায় আর সরকার বিরোধী দলকে অভিযুক্ত করে।”

“দেখুন এক দশক আগেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি করত কিন্তু তারা সাংবাদিকদের আক্রমণ করত না। কিন্তু এখন দেখা যায় সাংবাদিকদের টার্গেট করে আক্রমণ করা হচ্ছে। এর কারণ হতে পারে যে সাংবাদিকদের আক্রমণ করলে বেশি প্রতিক্রিয়া হয়,” বলেন শাহ আলমগীর।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেন, ‘‘এটা সত্য যে বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। সিপিজে’র সূচকে উন্নতি করতে হলে বাংলাদেশকে সাংবাদিক হত্যার বিচার করতে হবে। এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয়, প্রেস ফ্রিডমের বিষয়।”

‘‘সর্বশেষ সিরাজগঞ্জে শিমুলকে হত্যা করা হয়েছে। শিমুলের রক্তমাখা আইডেনটিটি কার্ডের ছবি সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বের বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে দেখানো হয়। এটা আমাদের জন্য ভালো উদাহরণ নয়,’’ বলেন মনজুরুল আহসান।

সাংবাদিক উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস বেনারকে বলেন, “আমার ছেলে গত ১০ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ। আমরা প্রেস কনফারেন্স করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। আমরা জানি না সে কবে ফিরে আসবে।"

সিপিজে সূচক অনুযায়ী, সোমালিয়াতে গত এক দশকে সর্বোচ্চ ২৬ জন সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার হয়নি। এরপর রয়েছে সিরিয়ার অবস্থান। সেখানে ১৭ জন সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার হয়নি। সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান সপ্তম। সেখানে ২১ জন সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি।

৫৭ ধারায় এক সাংবাদিক গ্রেপ্তার

কুড়িগ্রামের রৌমারীতে আনিছুর রহমান আনিস নামের এক সাংবাদিকে আইসিটি আইনের ৫৭ (২) ধারায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁকে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার সময় তাঁর নিজ উপজেলার কর্তিমারী বাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁকে কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বিকৃত ছবি প্রকাশের মামলা করা হয়। ঘটনার প্রায় দু’মাস পর পুলিশ মূল অভিযুক্ত সুমন মিয়াকে আটক করতে না পারলেও তথ্য উদ্ঘাটনকারী সাংবাদিককে মিথ্যা উক্তিমূলে মামলায় আসামি করে।

অভিযুক্ত আনিছুর রহমানের দাবি, তিনি কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীর যাদুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কতিপয় ভূমিদস্যু নেতা এবং পুলিশের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেন। এতে উভয় পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়ে পারস্পরিক যোগসাজশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে।

আনিছুর জানান, প্রকৃত পক্ষে গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি ও যাদুরচর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহ কামাল স্থানীয় বাজারে চা খাচ্ছিলেন। এমন সময় হাটখোলাপাড়া এলাকার আব্দুল্লাহ মিয়ার ছেলে সুমন মিয়ার (২৪) ফেসবুক আইডি থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিকৃত ছবি সংবলিত একটি পোস্ট আসে।

আনিছ তাৎক্ষণিক ওই পোস্টটির স্ক্রিন শট নিয়ে যুবলীগ নেতা শাহ কামালকে ব্যবস্থা নিতে বলেন এবং নিজের পেশাগত কাজের প্রয়োজনে স্ক্রিনশটটি সংরক্ষণ করেন।

এরপর শাহ কামাল গত ৮ সেপ্টেম্বর রৌমারী থানায় সুমন মিয়াকে অভিযুক্ত করে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু পুলিশ দীর্ঘদিন তা আমলে নেয়নি। পরে পুলিশ এ ব্যাপারে সুমনের বিরুদ্ধে মামলা করতে আনিছুরকে চাপ দেয়। আনিছুর রাজি না হওয়ায় মঙ্গলবার রাতে তাঁকে আটক করার পর মামলা রুজু করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

আনিছুরের ছোট বোন পারভীন আক্তার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “যাদুরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাখওয়াত হোসেন সবুজ এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী। মূলত তিনি আমাদের জমি জবর দখল করে রেখেছেন। এ নিয়ে পারিবারিক বিরোধ চলছে। তাই যুবলীগ নেতাকে দিয়ে আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে।”

এ ব্যাপারে রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গির আলম বেনারকে জানান, শাহ কামালের অভিযোগের ভিত্তিতে আনিছুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে শাহ কামাল বেনারকে জানান, তিনি আনিছুরের কাছ থেকে বিকৃত ছবির তথ্য পেয়ে রৌমারী থানায় একটি অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু সেখানে তিনি আনিছকে অভিযুক্ত করেননি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।