ভুয়া সংবাদ ছড়ানোয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ টুইটার ও ফেসবুকের

জেসমিন পাপড়ি
2018.12.21
ঢাকা
181221_facebook_1000.jpeg বিবিসি বাংলার নকল পেজ তৈরি করে বিএনপির নামে ছড়ানো একটি ভুয়া সংবাদ।
[সৌজন্যে: ফেসবুক নিউজরুম]

ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পেজ ব্যবহার করে ‘বিরোধী দলের বিপক্ষে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানোর’ সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ এনেছে ফেসবুক ও টুইটার।

জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে এই অভিযোগে মোট ৩০টি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পেজ বন্ধ করেছে জনপ্রিয় এই দুটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

বৃহস্পতিবার সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন নয়টি নতুন ভুয়া পেজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে ফেসবুক।

একইসাথে ছয়টি ভুয়া একাউন্টও বন্ধ করেছে বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ব্যবহারকারীর এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। একইদিন টুইটার কর্তৃপক্ষও বাংলাদেশ থেকে খোলা ১৫টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার কথা জানায়।

একাউন্টগুলো ‘সমন্বিতভাবে তথ্য জালিয়াতিতে’ ব্যবহার এবং ‘বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালাচ্ছিল’ বলে অভিযোগ এনেছে ফেসবুক ও টুইটার। এসব কাজে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে পারে বলেও মনে করছে তারা।

বিবৃতিতে ফেসবুক বলছে, “আমাদের তদন্ত ইঙ্গিত করছে যে এর সঙ্গে যেসব ব্যক্তি জড়িত, তাদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।”

এক টুইটে টুইটার সেইফটিও জানায়, “প্রাথমিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আমাদের মনে হচ্ছে, এসব অ্যাকাউন্টের কয়েকটির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া লোকজনের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।”

এই অভিযোগ সত্য হলে ক্ষমতা ব্যবহার করে বিরোধীদের বিরুদ্ধে এমন কাজ অনৈতিক বলছেন বিশ্লেষকেরা। যদিও এই পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি অস্বীকার করে নিজেরাই মিথ্যা প্রচারণার শিকার বলে দাবি করেছে ক্ষমতাসীনেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক বেনারকে বলেন, “এটা দুঃখজনক। আগে যারা ক্ষমতায় ছিল তারাই এখন ক্ষমতায় আছে, তবে নির্বাচন অপারেট করার জন্য। অর্থাৎ তারা নির্বাচনকালীন সরকার। তারা যদি একই রকম আচরণ করে, সেটা দুঃখজনক। এটা অনৈতিক। এটা হওয়া উচিত নয়।”

“সরকারের উচিত একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমস্ত আয়োজন করা। সেটা না করে তারা যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য এসব কাজ করেন তবে তা নিন্দনীয়,” বলেন তিনি।

ড. ফাহমিদুল মনে করেন, “সরকারের দায়িত্ব তো আরো বেশি। বিরোধী দল ক্ষমতায় আসতে অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু যারা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে আছে তারা যদি এটা করে তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।”

শুক্রবার নির্বাচন কমিশনের সাথে দেখা করার পর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমামের কাছে ফেসবুকের ভুয়া অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জবাব না দিয়ে আওয়ামী লীগের কনিষ্ঠ নেতা বিপ্লব বড়ুয়াকে এর জবাব দিতে বলেন।

বেনার প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, “এই সকল অ্যাকাউন্টের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। কারা এগুলো পরিচালনা করে এব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নেই।”

“ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণার শিকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে বলা হয় আওয়ামী লীগ অফিসে সাতজন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে,” তিনি বলেন।

বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, “আমাদের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। কিন্তু তাঁর নাম ব্যবহার করে অনেক ভুয়া অ্যাকাউন্ট আছে। সুতরাং, এ সকল অ্যাক্যাউন্টের সাথে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”

তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি বেনারকে বলেন, “দেশের বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। এটাকে ভোট প্রক্রিয়া বলা যাবে না। ক্ষমতায় থেকে দুঃশাসন মানুষের উপর আবার চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সব ধরনের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।”

“তারই অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও ব্যবহার করছে বিভিন্নভাবে। ফেসবকু, টুইটার সেই প্রমাণই দিলো,” বলেন তিনি।

ফেইসবুকের ‘সাইবার সিকিউরিটি পলিসি’র প্রধান নাথানিয়েল গ্লেইশার বলেন, “ফেইসবুকের নীতির সঙ্গে এই ধরনের আচরণ যায় না। আমরা চাই না কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি কিংবা কারও সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াক।”

তীব্র চাপের মুখে ফেসবুক ও অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বিভ্রান্তিকর বা অবৈধ তথ্য সরিয়ে ফেলা, আপলোড ও তা ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা বাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পেজ বন্ধ করা হলো। এগুলো বন্ধ করতে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেয় ফেসবুক ও টুইটার।

ইন্টারনেটে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় কাজ করে আসা গ্রাফিকা নামে একটি কোম্পানিকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে এই ১৫টি বাংলাদেশি পাতা ও একাউন্ট বন্ধ করা হয় বলে জানায় ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ।

বন্ধ করা পাতাগুলোর মধ্যে আছে বিডিএসনিউজ ২৪ ডটকম, বিবিসি-বাংলা নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট, নিউজ দিনেররাত ২৪ ডটকম। তবে বন্ধ করা ছয়টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের তথ্য প্রকাশ করেনি ফেসবুক।

ফেসবুক জানায়, এসব পাতার মধ্যে একটির ফলোয়ার সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯০০ জন। পাতাগুলোর বিজ্ঞাপন বাবদ (বুস্ট) ৮০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রথম আর গত নভেম্বরে সর্বশেষ বুস্ট করা হয়।

বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে চিহ্নিত করার পর বন্ধ করা ১৫টি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি টুইটারও।

তবে টুইটার জানায়, বন্ধ করে দেওয়া অ্যাকাউন্টগুলোর বেশিরভাগের ‘ফলোয়ার’ সংখ্যা ৫০ এর কম ছিল। এসব অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে তাদের তদন্ত এখনও চলছে এবং ভবিষ্যতে আরও অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

ফেসবুক যেসব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের জনপ্রিয় পত্রিকার ওয়েবসাইটের নামের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা। নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু এমন নকল পোর্টাল চালু করে সেখান থেকে ফেইক নিউজ ছড়ানোর অভিযোগে কিছুদিন আগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছিল র‌্যাব।

সে সময় র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আটকৃতরা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জড়িত।

ফেসবুকে গুজব: গ্রেপ্তার তিন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-২। তারা হলেন- ওয়াহিদুন্নবী, আরাফাত ওরফে তারুণ্য তামাদি ও আবদুল্লাজ জাবিদ। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাতে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। নির্বাচন ঘিরে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর জন্য বাংলাদেশ থেকে খোলা দুই ডজনের বেশি ফেইসবুক ও টুইটার পেজ ও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার পর এ কথা বললেন তিনি।

শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) বার্ষিক সাধারণ সভায় বেনজীর আহমেদ বলেন, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে আর অপরাধও কমে আসছে ঠিকই। আবার সেই সঙ্গে নতুন ধরনের অপরাধ হচ্ছে- ফিন্যান্সিয়াল ও সাইবার অপরাধ।

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।