ব্যয় সংকোচনের মধ্যে মেট্রোরেলের খরচ বৃদ্ধি সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা
2022.07.19
ঢাকা

দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোসহ সরকারের ব্যয় সংকোচন পদক্ষেপ ঘোষণার মধ্যেই মেট্রোরেলের ব্যয় ও বাস্তবায়নকাল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ডেভেলপমেন্ট (লাইন-৬) প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র ও উপসচিব শাহেদুর রহমান।
ফলে বর্তমানে প্রকল্পটির মোট খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা, যা মূল খরচের চেয়ে প্রায় ৫২ শতাংশ বেশি।
দেশের প্রথম মেট্রোরেলের একাংশ চালু হওয়ার মাত্র চার মাস আগে এই ব্যয় বাড়ানো হলো।
এর আগে অগ্রাধিকার নয়, এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় সরকার।
বর্ধিত ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা মূলত ব্যয় হবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন মেট্রোরেলকে মতিঝিলের অদূরে কমলাপুর রেল স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করতে। এর দূরত্ব ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার।
বর্ধিত খরচের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে আট হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ হিসাবে জাইকা দেবে প্রায় তিন হাজার ১২৪ কোটি টাকা।
মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম.এ.এন. সিদ্দিক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমাদের মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম অংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ শতকরা ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজও ৭০ ভাগের বেশি শেষ হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি শতকরা ৮০ ভাগের বেশি।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা রাখি, এ বছর ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশটি চালু করা হবে।”
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “আজ একনেক সভায় মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত সংযোগ ও অন্যান্য খরচের জন্য বাড়তি প্রায় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের মূল প্রকল্পটি ২০১২ সালে করা হয়। সেসময়ও মতিঝিল থেকে মেট্রোরেলটি কমলাপুর স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি। এর অন্যতম কারণ হলো সরকার জমি অধিগ্রহন করতে চায়নি।”
সিদ্দিক বলেন, “তবে, এখন সরকার চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শাপলা চত্বর থেকে সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে দিয়ে হাতের বাম দিকে মেট্রোরেলের বর্ধিত অংশটি নির্মাণ করা হবে। এই জন্য সরকারি এবং বেসরকারিসহ মোট প্রায় পাঁচ একরের মতো জমি অধিগ্রহন করা হবে।”
প্রকল্পের উচ্চ খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওই অঞ্চলে জমির মূল্য খুব বেশি। সরকারের বর্তমান নীতি অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ করলে তিনগুণ দাম পরিশোধ করতে হয়।”
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “তবে, এই ব্যয় বৃদ্ধি করা হলেও সমুদয় অর্থ একসাথে প্রয়োজন হবে না।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা হলে, প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ দিকে এতো খরচ বৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এসে নতুন করে আরেকটি লিঙ্ক লাইন নির্মাণ এবং প্রকল্পের খরচ ও সময় বৃদ্ধি হওয়াটা দু:খজনক। এই প্রকল্পটির পরিকল্পনা আসলে ভালোভাবে করা হয়নি। সেকারণেই প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “ভালো পরিকল্পনা না হওয়ার কারণ হলো এই প্রকল্পের প্রধান প্রশাসনের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যাঁর প্রযুক্তি অথবা কারিগরি শিক্ষা নেই। এমআরটি হলো খুব জটিল প্রযুক্তির একটি।”
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “সম্ভবত বাংলাদেশ প্রথম দেশ যেখানে মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে একজন নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তির নেতৃত্বে। পৃথিবীর অন্যকোনও দেশে এটি সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।”
তিনি বলেন, “যদি কোনও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি এই প্রকল্পের পরিচালক হতেন, তাহলে বার বার প্রকল্প সংশোধন করতে হতো না; খরচও বৃদ্ধি হতো না।”
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “এভাবে বার বার প্রকল্পের খরচ ও সময় বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের অর্থ অপচয় করার মানে হয় না।”
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে ই-মেইলে জাইকার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রাজধানী ঢাকার যানজট দূর করতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশে প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, পল্টনের মধ্য দিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বর পর্যন্ত মেট্রোরেলের দূরত্ব সোয়া ২১ কিলোমিটার। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩০ মিনিট।
কিছুক্ষণ পর পর দুই পাশে ট্রেন চলাচল করবে। ফলে নীচে সড়কের ওপর চাপ কমবে এবং যানজট বহুলাংশে কমে আসবে বলে আশা করছে সরকার।
একনেক সভায় উপস্থাপিত প্রকল্পের কাগজপত্র অনুযায়ী, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ডেভেলপমেন্ট (লাইন-৬) প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। একনেকের সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ও বাড়ানো হয়েছে। নতুন সময়সীমা ডিসেম্বর ২০২৫।
খরচ ধরা হয়, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার বেশি। এই অর্থের মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ঋণ হিসাবে প্রদানের করে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার বেশি অর্থ প্রদান করছে।