লেবানন থেকে ফিরলেন ৭১ বাংলাদেশি, ফেরার অপেক্ষায় আরো অনেক

শরীফ খিয়াম ও জেসমিন পাপড়ি
2020.08.12
ঢাকা
200812_From_Lebanon_1000.jpg বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে লেবান থেকে ঢাকায় ফিরে আসা প্রবাসীরা বিমান থেকে নেমে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনালের দিকে যাচ্ছেন। ১২ আগস্ট ২০২০।
[সৌজন্যে: আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর।

বৈধ কাগজপত্র না থাকা ৭১ জন প্রবাসী বুধবার লেবানন থেকে দেশে ফিরেছেন। বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে বুধবার সকালে তাঁরা ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।

স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে আগ্রহী কাগজপত্র না থাকা সাত হাজার ৭৪৫ জন প্রবাসীকে লেবান থেকে ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবেই এই ৭১ জন ফিরেছেন বলে বেনারকে জানান বৈরুতে বাংলাদেশের দূতাবাসের প্রথম সচিব আবদুল্লাহ আল মামুন।

গত সপ্তাহে বৈরুতে বোমা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের সহায়তা সামগ্রী নিয়ে রোববার লেবাননে গিয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি পরিবহন বিমান।

ওই বিমানটি “ফিরতি পথে বৈরুত থেকে ৭১ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনে,” বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

“তাঁরা আমাদের সাথে আসতে পেরে খুশি। তাঁদের সাহায্য করতে পেরে আমাদেরও ভালো লেগেছে,” বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন শান্তনু চৌধুরী।

বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দূতাবাস নির্ধারিত বিমান ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক পরিশোধ করেছিলেন এইসব অবৈধ অভিবাসীরা।

তবে যারা বিমানবাহিনীর বিমানে ফিরেছেন, তাঁদের কাছ থেকে বিমান ভাড়া বাবদ আগে নেওয়া টাকা বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ ফেরত দিয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ফেরত আসা প্রবাসীরা।

দূতাবাসের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরা কর্মসূচির আওতায় প্রয়োজনীয় খরচ দিয়ে নাম নিবন্ধনকারীদের মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফেরেন ৪৫০ বাংলাদেশি।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে গেলেও গত ২ আগস্ট থেকে প্রক্রিয়াটি আবার শুরু হয়।

এ দফায় এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার প্রবাসীকে দেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বৈরুত দূতাবাসের কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। “বাকিদেরও পর্যায়ক্রমে দেশে পাঠানোর চেষ্টা চলছে,” বলেন তিনি।

জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থান উন্নয়ন ব্যুরোর বিএমইটি) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৬৭ হাজার বাংলাদেশি কর্মী লেবাননে গিয়েছেন। যাদের মধ্যে নারী এক লাখ সাত হাজার।

 

 

ফেরার কারণ লেবাননের পরিস্থিতি

লেবানন ফেরতদের দাবি, সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফেরাও স্বস্তিদায়ক।

বৈরুত বিস্ফোরণের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ লেবানন শাখার সমন্বয়ক মোহাম্মদ রতন সরকার বেনারকে জানান, দেশটিতে বৈধ কাগজপত্রবিহীন প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন।

“তাদের মধ্যে ফেরার তাড়াটা বেশি,” বলেন রতন সরকার।

নিঃস্ব হয়ে ফেরা, রয়ে গেছে বকেয়া ঋণ

রিক্রুটিং এজেন্সির দালালকে চার লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ২০১৪ সালে তিন মাসের ভিসা নিয়ে লেবানন গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশরাফুল ইসলাম রাজু (২৮)। সেখানে থাকা ও কাজের জন্য বৈধ কাগজপত্র করাতে তাঁর খরচ হয়েছিল আরও প্রায় দুই লাখ টাকা।

রাজু জানান, লেবাননে গিয়ে তিন মাসের বেশি থাকতে হলে বা কাজ করতে হলে ‘আকামা’ বা কাজের অনুমতিপত্র করাতে হয় এবং তা প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়।

“যাদের আকামা নবায়ন করা হয় না, তারা বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত হয়” জানিয়ে রাজু বলেন, তিনি নিজেও গত পাঁচ বছর ধরে লেবাননে অবৈধ হিসাবে ছিলেন।

রাজুরও আট মাস আগে একইভাবে লেবানন গিয়েছিলেন তাঁর ছোট ভাই আরিফুল ইসলাম। তাঁরা বৈরুতের কাছে জুদা নামের একটি এলাকায় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিন দিনের ব্যবধানে দুজনেই দেশে ফিরেছেন।

“দুই ভাই এক সাথে দেশের বাইরে কাজ করতাম বলে পরিবারের আর্থিক অবস্থাটা ভালোই ছিল। এখন দুজনকেই এক সাথে চলে আসতে হলো,” বলেন রাজু।

লেবানন থেকে বুধবার দেশে ফেরা কিশোরগঞ্জের পিরিজপুরের আব্দুস সবুর পাপ্পু বেনারকে বলেন, “বাবার দোকান জামানত রেখে যে ঋণ নিয়ে লেবানন গিয়েছিলাম, সেটাই এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। উল্টো পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেখানকার থাকা-খাওয়ার খরচ মেটাতে হয়েছে।”

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করা পাপ্পু জানান, চার লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে লেবাননে গিয়েছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, “সেখানে এক বছর তিন মাস বৈধ ছিলাম। বাকি সময়টা অবৈধ হিসেবে।”

করোনার কারণে ফিরেছেন ৫০ হাজার, ৭০ শতাংশ বেকার

প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বুধবার বেনারকে জানান, কোভিড পরিস্থিতির কারণে কমপক্ষে ৫০ হাজার প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন।

এর আগে সোমবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন এর মধ্যে দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের প্রায় ৭০ শতাংশ এখন বেকার।

বেনারকে মন্ত্রী বলেন, “বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য মোট সাতশ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা ও পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। মাত্র চার শতাংশ সরল সুদে ঋণ পাবে তারা।”

এরই অংশ হিসাবে গত ১৫ জুলাই থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসনে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।

তবে বুধবার পর্যন্ত একজনকেও ঋণ দেয়া যায়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিডিএম) মো. জসীম উদ্দিন।

“জায়গা-জমি বিক্রি করে বিদেশ গিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন, এমন মানুষদের ঋণ দিতে চাই আমরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যাদের পাঁচতলা বাড়ি আছে, বড় ব্যবসা আছে, তাঁরাও এই ঋণের জন্য আবেদন করেছেন,” বলেন তিনি।

আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত নিঃস্ব ব্যক্তি আবেদন করলেও তাঁরা সুনির্দিষ্ট খাত বা ব্যবসার ধরন উল্লেখ করেননি। এই অবস্থায় তাঁদের ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের দিয়ে বিদেশ ফেরতদের ‘কাউন্সেলিং’ শুরু করানো হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর মনে করেন, “ঋণ দেওয়ার বিষয়টি যেহেতু সময়সাপেক্ষ, অভাবগ্রস্ত বিদেশ ফেরতদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। নয়তো তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়বেন।”

কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে বিদেশ ফেরত অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন কী করা উচিত। নয়তো ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন না তাঁরা।”

আইওএম জানিয়েছে, বিদেশ ফেরতদের প্রায় ৭৫ শতাংশ আবার অভিবাসনে আগ্রহী। তাঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের আগে যে দেশে কাজ করতেন সেই দেশেই পুনরায় যেতে ইচ্ছুক।

মাত্র ৬০ শতাংশ আরও ভালো বেতনের চাকরি নিশ্চিত করতে দক্ষতা বৃদ্ধিতেও আগ্রহী বলেও জানিয়েছে।

“করোনাত্তোর পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন করে ফেরত আসা কর্মীদের পুনরায় বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হবে,” বলেন মন্ত্রী ইমরান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।