প্রায় দুই মাস ধরে সন্দেহবশত আটক দুই শতাধিক প্রবাসী

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.08.24
ঢাকা
200824_Expat_in_Jail-1000.jpeg ঢাকা মহানগর মেট্রোপলিটান আদালতের সামনে বিচারপ্রার্থীদের ভিড়। ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

কোনো অপরাধ না করে শুধু সন্দেহের কারণে প্রায় দুই মাস ধরে জেল হাজতে রয়েছেন কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন ফেরত ২১৯ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় তাঁদের গ্রেপ্তারের পর ঢাকার তুরাগ থানা পুলিশের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, এদের ছেড়ে দিলে সারাদেশে ডাকাতি, খুন, জঙ্গি ও নাশকতাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হবে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশের আইনানুযায়ী ৫৪ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি আটক রাখার সুযোগ নেই। এভাবে আটক রাখা সংবিধান ও মৌলিক মানবাধিকারের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।

তুরাগ থানায় দায়ের করা ৪ জুলাইর সাধারণ ডায়েরি অনুযায়ী, কুয়েত থেকে ১৪১, কাতার থেকে ৩৯ এবং বাহরাইন থেকে আসা ৩৯ জন প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফেরার পর উত্তরার ডিয়াবাড়ীতে ১৪ দিনের কোয়ারাইন্টাইনে রাখা হয়।

“কোয়ারান্টাইন শেষ হওয়ার পরই পুলিশ তাঁদেরকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহজনক কারণে আটক করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়,” বেনারকে বলেন প্রবাসীদের আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত।

পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি, শুধু সাধারণ ডায়েরি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই ডায়েরিতে বলা হয়েছে তাঁরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন।”

সর্বশেষ ১৮ জুলাইসহ কয়েক দফায় ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালতে তাঁদের জামিনের আবেদন করা হলেও তা মঞ্জুর হয়নি বলে জানান জীবনানন্দ।

তিনি বলেন, “আমি আদালতে বলেছি ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৫৪ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি আটক রাখার সুযোগ নেই। কিন্তু ৫১ দিন ধরে ২১৯ জন প্রবাসী কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক আছেন। এটি আইনের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।”

“এই মানুষগুলো এত দরিদ্র যে এদের পরিবারের সদস্যরা ঢাকা এসে তাঁদের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারছেন না। তাঁরা বিদেশ থেকে রাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থ পাঠাবেন। আবার দেশে ফিরলে কারাগারে থাকবেন, হয়রানির শিকার হবেন সেটি হতে পারে না,” বলেন বলেন জীবনানন্দ।

বাহরাইন ফেরত কুমিল্লার চান্দিনা অধিবাসী মো. রাসেলের স্ত্রী মিনুয়ারা বেনারকে জানান, তাঁর স্বামী ২০১৫ সালে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নিয়ে বাহরাইন যান। তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি সেখানে অনিয়মিত হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, “দেশে ফিরে এখন সে জেলে আছে জেনেছি। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা কীভাবে চলব? কে তাঁকে বের করবে?”

পুলিশের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, আটক ২১৯ বাংলাদেশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ওই সকল দেশে সাজাপ্রাপ্ত হন। করোনাভাইরাস মহামারির বিষয়টি বিবেচনা করে তাঁদের সাজা মওকুফ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

ওই ব্যক্তিরা বিদেশে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন জানিয়ে ডায়েরিতে বলা হয়, তাঁদের পূর্ণ নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি।

“এমতাবস্থায় তাঁদের ছেড়ে দেয়া হলে তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, পারিবারিক সহিংসতা, জঙ্গি নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে,” বলা হয় ডায়েরিতে।

এতে বলা হয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।

আটকদের অনেকেই ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন জানিয়ে আইনজীবী জীবনানন্দ বলেন, “তাঁরা তো বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করেননি। আবার তাঁরা যে দেশে অপরাধ করেছেন সেদেশও তাঁদের মাফ করে দিয়েছে। সুতরাং, তাঁরা কোনো অপরাধী নন।”

অভিযোগ ছাড়াই ওই প্রবাসীদের কেন আটকে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, এদের প্রায় প্রত্যেকেই কুয়েত, কাতার ও বাইরাইনে ‘জঘন্য অপরাধের’ সাথে জড়িত ছিলেন।

এদের কেউ অর্থ পাচার, কেউ মাদক, কেউ মানবপাচার, কেউ যৌন সংক্রান্ত অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রত্যেকের সেসব দেশে সাজা হয়।”

করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসার শর্তে সেসব দেশ তাঁদের সাজা মওকুফ করেছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যেহেতু তারা সেখানে অপরাধ করেছে সেহেতু আমরা প্রতিটি লোকের ব্যক্তিগত রেকর্ড দেখতে চাই।”

এদিকে আটক প্রবাসীরা বিদেশে “অপরাধ করেছেন কি না সেব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যায়,” মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, তাঁরা বিদেশের অপরাধ করলেও “বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই তাঁদের আটকে রাখা।”

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “তাঁরা তো বাংলাদেশে অপরাধ করেননি। আবার যেদেশে অপরাধ করেছেন সেই দেশ তাঁদের মাফ করে দিয়েছে। তাই আইনের ‍দৃষ্টিতে তাঁরা যখন বাংলাদেশে ফিরেছেন তখন তাঁদের আর অপরাধী বলা যাবে না।”

বাংলাদেশের ফৌজাদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সন্দেহবশত কাউকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি আটক রাখা যায় না জানিয়ে ড. মিজানুর রহমান বলেন, “২১৯ জন প্রবাসী শ্রমিকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না এনে তাঁদেরকে ৫১ দিন আটক রাখা সম্পূর্ণ বেআইনি, সংবিধান পরিপন্থী এবং মৌলিক মানবাধিকারের বিরোধী।”

“আমি আশা রাখব আদালত সার্বিক বিষয়টি মাথায় রেখে এই ২১৯ জনকে মুক্তির আদেশ দেবেন,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।