দুই সপ্তাহ ধরে সাগরে ভাসতে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যেকোনো মূল্যে ইউরোপে ঢুকতে চান, আর তিউনিসিয়া চায় বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার পূর্ণ নিশ্চয়তা।
এই পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে পড়া বাংলাদেশ দুই পক্ষকেই বোঝানোর চেষ্টা করছে। অভিাভাসরপ্রত্যাশীদের বুঝিয়ে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের আপত্তি নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক চিরঞ্জীব সরকার বেনারকে জানান, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তিনি তিউনিসিয়ায় পৌঁছেছেন।
তবে শুক্রবার রাত পর্যন্ত ভাসতে থাকা এই মানুষগুলোর ব্যাপারে তিউনিসিয়া ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
“আমরা তিউনিসিয়াকে অনুরোধ করব, তাঁরা যেন বাংলাদেশের নাগরিকদের আপাতত আশ্রয় দেয় এবং দ্রুত ট্রাভেল পারমিট দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মিশরের একটি প্রতিনিধিদলও যুক্ত হয়েছে। কারণ নৌকায় কয়েকজন মিশরীয় নাগরিকও রয়েছে,” চিরঞ্জীব সরকার বেনারকে বলেন।
গত ৩১ মে তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ৬৪ বাংলাদেশিসহ ৭৫ জন অভিবাসনপ্রত্যাসীকে উদ্ধার করে মিশরীয় একটি নৌযান। তবে তিউনিসিয়া নৌকাটিকে তাদের সীমানায় নোঙর করতে দিতে চাইছে না।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য হচ্ছে, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা দেশে ফিরে আসবেন মর্মে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট না করা পর্যন্ত দেশটি নৌকাটিকে নোঙর করার অনুমতি দেবে না।
এ প্রসঙ্গে চিরঞ্জীব সরকার বলেন, নৌকায় ভাসমান বাংলাদেশিরা ফিরতে চাইছে না। তারা বলছে, অচল হয়ে যাওয়া নৌকার ইঞ্জিন ঠিক করে দেওয়ার জন্য। এরপর যেকোনো মূল্যে তাঁরা ইউরোপ যেতে চায়।
“অন্যদিকে তিউনিসিয়া জানিয়ে দিয়েছে তাদের শরণার্থী শিবিরে নতুন করে কাউকে আশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ দু’পক্ষকেই বোঝানোর চেষ্টা করছে এবং সমাধানের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী,” জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই পদস্থ কর্মকর্তা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, তিউনিসিয়ার উপকূলীয় শহর জারজিস থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নৌকাটি ভেসে রয়েছে। সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংস্থাটি আরও জানায়, অভিবাসন প্রত্যাশীরা খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা নিতে চাইছে না এবং তাদের ইউরোপে পাঠানোর বন্দোবস্ত করার দাবি জানাচ্ছে। শুক্রবার পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে লিবিয়ায় হট নাম্বার চালু করেছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করেছে।
দুই পক্ষ কেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) সাবেক কর্মকর্তা ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলছিলেন, বাংলাদেশের এসব অভিবাসনপ্রত্যাশী মনে করছে, ভিটেমাটি বেচে বা বন্ধক রেখে তাঁরা টাকা দিয়েছে, তাই যেকোনো উপায়ে ইউরোপে পৌঁছাবে। এই পরিস্থিতির জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। এর দায় তাঁরা এড়াতে পারে না।
“দেখুন, আমি বলব এসব দুঘর্টনার দায় বেপরোয়া হয়ে যারা ইউরোপে পাড়ি জমাতে চায় তাদের এবং একই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। সরকারি সংস্থাগুলোর এমন একটা ভাব যে, তুমি যেভাবেই হোক গিয়ে পৌঁছাও, আমার কোনো আপত্তি নেই,” আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন।
আসিফ বলছিলেন, যারা ইউরোপে যেতে মরিয়া হয়ে উঠছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে বহু বছর আগে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন বা গ্রামের লোকজন অবৈধভাবে ইউরোপের কোনো না কোনো দেশে গেছে। তাঁদের বোঝাতে হবে যে, এখন ইউরোপে যাওয়া আগের মতো সহজ নয়।
“যেখানে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে পশ্চিম ইউরোপে মানুষ কাজ করতে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এই খবর অভিবাসনপ্রত্যাশীরা পাচ্ছে না। খবরটা দেওয়া এবং সচেতনতা সৃষ্টি করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের।"
এ জন্য আসিফ মুনীর মূলত দায়ি করেন বাংলাদেশের অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে।
“পর্যটক বা ছাত্র ভিসায় যারা বাংলাদেশ ছাড়ছে তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ খোঁজখবর করলেই বুঝতে পারবে তারা সত্যিই বেড়াতে বা পড়তে যাচ্ছে কি না। সেটা কিন্তু যাচাই-বাছাই হচ্ছে না,” আসিফ মুনীর বলেন।
পাঁচ - ছয়টি সিন্ডিকেট সক্রিয়
গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরে দুটি নৌকা ডুবে যায়। নৌকা দুটির একটিতে ছিলেন ৫০ জন ও অন্যটিতে ৭৫ জন। ধারণা করা হচ্ছে, লিবিয়ার জওয়ারা থেকে ছেড়ে একটি নৌকা ইতালি পৌঁছাতে পারলেও, অন্যটি পারেনি। ওই নৌকায় ৫৪ জন বাংলাদেশি ছিলেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা রয়েছে।
ওই ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যে র্যাব অবৈধভাবে ইউরোপে পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, দেশে পাঁচ-ছয়টি চক্র রয়েছে, যারা অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের বিদেশে পাঠাচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতী মাহমুদ খান ওই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাচারকারীরা সাত-আট লাখ টাকার চুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জড়ো করছে। তারপর ঠেলে দিচ্ছে বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে। ইউরোপে প্রবেশে কড়াকড়ি হওয়ায় চক্রগুলো এখন পরিস্থিতি বুঝে রুট বদলাচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ভর করে আছে দেশটির অর্থনীতি। অভিযোগ রয়েছে, মানুষ ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে কি না সেদিকে যথেষ্ট নজর দেয় না সরকারে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বেনারকে বলেন, “মানুষ যেন ইউরোপ যেতে মরিয়া, কোনোভাবেই তাদের আটকানো যাচ্ছে না।”
“আমরা ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলছি, ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যাবেন না। কিন্তু অনেকেই তা শুনছে না। তারপরও তাদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে,” জানান সেলিম রেজা। তিনি আরও বলেন, এই প্রবণতা ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয় জোরদার করা জরুরি।