সমুদ্রপথে আসা ৬০ বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে ইতালি

শরীফ খিয়াম ও জেসমিন পাপড়ি
2020.07.06
ঢাকা
200706_Italy_Sea_Arrivals_1000.jpg ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়ার পর ইতালি সরকার তীরে নামার অনুমতি দেওয়ায় উদ্ধারকারী জাহাজ দ্য ওশেন ভাইকিং এর ভেতর ঢোল বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এই দলে ৬০ জন বাংলাদেশিও রয়েছেন। ৫ জুলাই ২০২০।
[এএফপি]

ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ৬০ বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ১৮০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে ইতালি। ইউরোপীয় সাহায্য সংস্থা এসওএস মেডিটারেনির উদ্ধারকারী জাহাজ দ্য ওশেন ভাইকিং থেকে তাঁদের একটি সরকারি জাহাজে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

দেশটির সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপাঞ্চল সিসিলিতে সোমবার এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর উদ্ধারকৃতদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের সতর্কতা হিসেবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা রয়েছে।

উদ্ধারকারী সংস্থা এসওএস মেডিটারেনির মুখপাত্র ফ্রান্সেসকো ক্রিয়েজো সোমবার বেনারকে বলেন, “ওশেন ভাইকিংয়ের মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া ১৮০ জন বেঁচে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে ৬০ জনই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তাঁরা বিভিন্ন বয়সের।”

তবে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের সম্পর্কে ইতালি সরকার বা কোনো সংস্থা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশের রোম দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মো. আরফানুল হক। তবে তাঁরা সংবাদমাধ্যমে খবরটি জেনেছেন বলে জানান তিনি।

ইউরোপ প্রবেশের উদ্দেশ্যে লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের চারটি দলকে গত মাসের শেষ সপ্তাহে উদ্ধার করে ওশেন ভাইকিং। কিন্তু তাঁদের তীরে ভেড়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। প্রায় সপ্তাহকাল ধরে ইতালির উপকূলে ভাসছে জাহাজটি।

এরই মধ্যে শুক্রবার মানবিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে জাহাজ কর্তৃপক্ষ অভিবাসনপ্রত্যাশী ও নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা করে। এ নিয়ে চলমান আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দেয় ইতালি।

“আমরা অনেক খুশি। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা। লিবিয়া ছিল জাহান্নামের মতো। এখন অন্তত শেষ দেখে নিতে পারব আমরা। পরিবারের লোকজনকে বলতে চাই, আমি এখনও বেঁচে আছি,” বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন ২৭ বছর বয়সী বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী রবিউল।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার যে ছয়টি রুট আছে, তার মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি হয়ে ঢোকার রুটটি সবচেয়ে জনপ্রিয়।”

“কারণ এ জায়গায় মানবপাচারকারীদের একটা শক্তিশালী অবস্থান আছে,” যোগ করেন তিনি।

‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি প্রকৃতি ২০১৯’ শীর্ষক এক প্রকাশনায় রামরু দাবি করেছে, একটি সংগঠিত মানব পাচারকারী চক্র বাংলাদেশিদের ভারত, দুবাই, তুরস্ক, লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়ার উপকূল দিয়ে নৌকায় করে ইতালি পাঠিয়ে থাকে।

“হয়ত সেখানে যারা পৌঁছাতে পেরেছেন, তারাই দেশে বার্তা দিচ্ছেন যে এখানে আসলে থাকা যায়। তাতে মানুষ প্রলুব্ধ হচ্ছে বলেই সেখানে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে,” বলেন ড. জালাল।

উদ্ধার হওয়া ১৮০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ইরিত্রিয়া, নাইজেরিয়াসহ আরো অনেক দেশের নাগরিক রয়েছেন বলে জানায় এএফপি। এদের মধ্যে, মধ্যে ২৫ জন অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক, দুইজন নারী, যার মধ্যে একজন গর্ভবতী।

 

 

নিঃসঙ্গ শিশুর তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ

ইতালির শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারির এই বছরের প্রথম ছয় মাসে অবৈধ সমুদ্রপথে ইতালি পৌঁছেছেন সহস্রাধিক বাংলাদেশি। যার মধ্যে তিন শতাধিক অপ্রাপ্তবয়স্ক।

আশ্রয়প্রার্থীরা বয়স কম দেখানোর কারণেই ইতালিতে নিঃসঙ্গ শিশু প্রবেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে পৌঁছেছে বলে ধারণা রোম দূতাবাসের কর্মকর্তা আরফানুল হকের।

“১৮ বছরের কম বয়সী হলে মানবিক বিবেচনায় তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হয় না। যে কারণে অনেক সময় দেখা যায়, জামাই-শ্বশুর একসাথে লাইনে দাঁড়িয়ে দুজনেই নিজেদের অনূর্ধ্ব ১৮ দাবি করছেন,” বেনারকে বলেন তিনি।

গবেষক ড. জালালও মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইনের সুবিধা নিয়ে ইউরোপে অবস্থান করতেই নিজেদের বয়স কমিয়ে বলছেন অনেক বাংলাদেশি।

‘ইতালিতে অভিবাসী শিশু’ শীর্ষক এক প্রকাশনা আইওএম বলেছে ২০১৭ সালে ইতালিতে আসা আশ্রয়-প্রত্যাশী শিশুদের মধ্যে ৮ শতাংশ ছিল বাংলাদেশি।

তবে আরফানুলের দাবি, “কোনো শিশুর পক্ষে এই পথ পাড়ি দিয়ে ইতালি আসা সম্ভব নয়।”

থামছেই না সমুদ্রপথে ইউরোপ যাত্রা

জাতিসংঘের হিসাবে, গত বছরে সাগরপথে ইতালি প্রবেশ করেছেন ৬০২ জন বাংলাদেশি। এর আগের বছর এই পথে ইতালি গিয়েছিলেন ৩৪৯ জন বাংলাদেশি।

একই বছরের মে মাসেই লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া ইতালিগামী নৌকাডুবির ঘটনায় কমপক্ষে ৪০-৪৫ বাংলাদেশি নিখোঁজ এবং ১৪ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছিলেন।

জুন মাসে আরেকটি বিকল নৌকা থেকে তিন সপ্তাহ ধরে তিউনিসিয়ার জলসীমায় ভেসে বেড়ানো ৬৪ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া, গত ২৮শ মে লিবিয়ার মিজদা অঞ্চলে মানবপাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের শিকার হন ৩৮ জন বাংলাদেশি। পরে তাঁদের গুলিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত এবং বাকি ১১ জন আহত হন।

এই বাংলাদেশিদের গন্তব্যও ইউরোপ ছিল বলে জানিয়েছেন ওই ঘটনায় জীবিত উদ্ধার হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা।

ড. জালাল মনে করেন, “তরুণরা ‘চ্যালেঞ্জ’ নিতে পছন্দ করেন। তাঁদের কাছে যেমন ডুবে মরার তথ্য আছে, তেমনি যারা পৌঁছাতে পেরেছেন তাঁদের তথ্যও আছে। এক্ষেত্রে দুইশ জন মারা গিয়েও যদি একজন পৌঁছাতে পারে, তাঁর প্রভাব ওই দুইশ জনের চেয়ে বেশি থাকে।”

স্পেন, মাল্টা, গ্রিস, সাইপ্রাস, বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া এবং স্লোভেনিয়ায় অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের প্রবেশের কথাও ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) নথিতে উল্লেখ রয়েছে।

তবে ইউএনএইচসিআর-এর ঢাকা অফিসে এ বিষয়ক কোনো তথ্য নেই বলে বেনারকে জানিয়েছেন সংস্থাটির স্থানীয় মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।