তিন বছরে বিদেশে আত্মহত্যা করেছেন ৫৩ নারী শ্রমিক

জেসমিন পাপড়ি
2019.07.19
ঢাকা
190719-BD-women-suicide_1000.jpeg শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লাশ গ্রহণ করছেন নিহত প্রবাসী শ্রমিকদের স্বজনেরা। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

দক্ষিণ–পশ্চিমের জেলা যশোরের বাসিন্দা সামসুন নাহারের (৩৭) স্বামী মারা যাওয়ার সময় তাঁদের একমাত্র সন্তানের বয়স ছিল আট বছর। সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে ২০১৮ সালে নারী শ্রমিক হিসেবে তিনি সৌদি আরব যান। কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় সেখানেই আত্মহত্যা করেন। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফেরে তাঁর মরদেহ।

শুধু সামসুন নাহার নন, গত তিন বছরে তাঁর মতো আরো ৫৩ বাংলাদেশি নারী শ্রমিক বিদেশে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেলেও অভিভাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে। কারণ অনেকের লাশ দেশে ফেরত আসে না।

সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি বছরই বিদেশে মারা যাওয়া নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে, সাথে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। যদিও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, সংখ্যাটি উদ্বেগজনক নয়।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বেনারকে বলেন, “প্রবাসী নারী কর্মীদের আত্মহত্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ধরনের কোনো গবেষণাও নেই। প্রবাসীদের মৃত্যু এবং তাঁদের মরদেহ দেশে আসার একটি তালিকা আছে।”

তবে ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, “সংখ্যা কম বা বেশি সে হিসাবে নয়, একজন অভিভাসী শ্রমিকের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুও কাম্য নয়। প্রতিটি মৃত্যুর কারণ সুষ্ঠুভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।”

“আর্থিক বা সামাজিকভাবে ভালনারেবল মেয়েরাই একটু ভালো থাকার আশায় বিদেশে যায়। নিশ্চয়ই সেখানে এমন ভয়ঙ্কর কিছু তাদের সাথে ঘটে, যাতে তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়,” বলেন হাসান।

শরিফুল হাসান বলেন, “কয়েক বছর ধরে নারী কর্মীদের মরদেহ আসার সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে, আত্মহত্যা এবং স্ট্রোক। সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে।”

পরিবারের অভিযোগের কথা বিবেচনা করে এবং মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণে ফেরত আসা মরদেহগুলো ময়না তদন্ত করার পক্ষেও মত দেন তিনি।

পরিবার মনে করে আত্মহত্যা নয়

বিমানবন্দরে​র প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর নারী কর্মীদরে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে একজন নারী কর্মী আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ আত্মহত্যা করে ১২ জন। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি বেড়ে হয় ২৩। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) আসা মরদেহগুলোর মধ্যে ১৭ জনের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা।

বিদেশে আত্মহত্যার করেছেন এমন পাঁচ কর্মীর পরিবারের সাথে বেনার প্রতিবেদকের কথা হয়। বেশির ভাগ পরিবারেই তাঁরা ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। পুরো পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে তাঁরা আত্মহত্যা করবেন, এটা মেনে নিতে পারছে না পরিবারগুলো।

স্বজনদের অভিযোগ, তাঁদেরকে হত্যার পরেই আত্মহত্যার ঘটনা সাজানো হয়েছে। তাছাড়া দেশে ফেরত আনার পরে ময়না তদন্ত হয় না বলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায় না বলে তাঁদের মত।

তবে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো বলছে, ময়না তদন্তের পরেই লাশ দেশে পাঠানো হয়।

সৌদি আরবে মারা যাওয়া সামসুন নাহারের ছেলে একরামুল মোল্লা (২০) বেনারকে বলেন, “অল্প বয়সে বাবাকে হারাই। পৃথিবীতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই। সেই মা আমাকে একা ফেলে বিদেশে আত্মহত্যা করবেন—এটা বিশ্বাস করি না।”

“সর্বশেষ যখন ফোনে কথা হয় মা বলল, দেশে ফিরতে চাই, এখানে নানা ধরনের কষ্ট। সন্তান বলে হয়তো সব কথা আমাকে তিনি বলতে পারেননি। এর এক সপ্তাহ পরে ‍শুনি মা আর নেই,” বলেন তিনি।

“হয়তো মা দেশে ফিরতে চাওয়ায় তারা তাকে মেরে ফেলে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেছে,” অভিযোগ একরামুলের।

তিনি জানান, প্রায় এক বছর কাজ করেছেন। কিন্তু মাত্র তিন মাসের বেতন পাঠিয়েছেন। তাকে নিয়মিত বেতন দেয়া হতো না। এমনকি দেশে ফোন করতেও দিত না। ফোন করলে দুই–তিন মিনিটের বেশি কথা বলতে পারতেন না।

স্বামী মারা যাওয়ার পর ১১ বছরের সন্তান রেখে ভাগ্য ফেরাতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব যান মুন্সীগঞ্জ সদরের জহুরা বেগম (৩২)। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই ওই বছরের ১৩ মে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে বাড়িতে খবর আসে। এরও নয়মাস পরে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জহুরার লাশ দেশে আনতে পারে তাঁর পরিবার।

জহুরার ভাই শামীম মিয়া বেনারকে বলেন, “যাওয়ার আড়াই মাসের মাথায় ওর গলায় টনসিল হয়। এ জন্য বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু মালিক ফিরতে দিতে রাজি ছিল না। এটা নিয়ে মালিকের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। ফোনে আমি তর্ক শুনেছি। এর দুদিন পরে এক বাংলাদেশি জহুরার মৃত্যুর খরব দেয়।”

“ওর এমন কোনো কষ্ট ছিল না যে, বিদেশে বসে আত্মহত্যা করবে। আর সে তো সন্তানকে নিয়ে স্বচ্ছলভাবে থাকার জন্য বিদেশে গিয়েছিল,” বলেন তিনি।

শামীম মিয়া বলেন, “আমি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ অনেক জায়গায় গিয়েছি, কিন্তু বিচার পেলাম না।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের মৌসুমি আক্তার (২০) দেড় বছর ধরে কাজ করছিলেন জর্ডানে। কিন্তু হঠাৎ একদিন সেখান থেকে খবর আসে মৌসুমি আত্মহত্যা করেছেন।

তাঁর চাচা ইমরান খান বেনারকে বলেন, “যে মেয়ে নিজের পরিবারের জন্য দেড় বছর পরিশ্রম করল, সে হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করবে। মৌসুমি না বললেও অন্য মাধ্যমে শুনেছিলাম শাররিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছিল সে।”

মৌসুমির মা আনোয়ারা খাতুন বেনারকে বলেন, “সে ফোনে বলত মা নানা রকম অশান্তিতে আছি। দেশে চলে আসব। কিন্তু মেয়েটা আমার লাশ হয়ে ফিরল। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালো দাগ ছিল। এটা খুন ছাড়া কিছুই নয়।”

তবে দূতাবাসের মিশন উপ-প্রধান ড. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এ ধরনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে সৌদি পুলিশ এবং ফরেনসিক বিভাগ যৌথভাবে রিপোর্ট দেয়। মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়া কোনো লাশ ফেরত পাঠানো হয় না।”

তাঁর মতে, বিদেশে এসে হোম সিক হয়ে পড়া, কাজের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা, আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই দক্ষ নারী কর্মী পাঠানোর ওপর ‍গুরুত্ব দেন তিনি।

তবে সৌদি আরবে নারী শ্রমিকেরা শাররীক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন সৌদি সরকার এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন মালিককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।”

বিশ্লেষণে দেখা যায়, মরদেহ আসা কর্মীদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।

আত্মহতা ছাড়াও নারী কর্মীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ‘স্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে ফিরেছে ৩৩১ জন নারী কর্মীর মরদেহ। এদের মধ্যে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১২০ জনের।

বিদেশে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বিদে​শ থেকে শ্রমিকদের লাশ আসার সংখ্যাও বেড়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৮৫টি, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯৭৩ টি এবং ২০১৮ সালে তিন হাজার ৩৫৩ টি প্রবাসী কর্মীর লাশ দেশে আসে। এ বছরের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩৭ জনের মরদেহ দেশে এসেছে।

এ ছাড়া চট্টগ্রামের শাহ আমানত এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়েও কিছু লাশ দেশে আসে।

২০১৮ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আসা ৩ হাজার ৩৫৩টি মরদেহের মধ্যে ১১২টি মরদেহ ছিল নারী কর্মীদের। এদের মধ্যে ২৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ১৫ জন দুর্ঘটনায়, ৪৩ জন স্ট্রোকে, স্বাভাবিক মৃত্যুসহ অন্যান্য কারণে ৩১ জন নারী কর্মীর মৃত্যু হয়।

আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৬০ নারী গৃহকর্মীর মরদেহ দেশে আসে। এদের মধ্যে ১৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০ জন স্ট্রোকে, দুর্ঘটনায় ১০জন, স্বাভাবিকসহ অন্যান্য কারণে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “বিদেশে নারী শ্রমিকেরা কেমন আছে, তা নজরদারির সুষ্ঠু ব্যবস্থা সরকার এখনো করতে পারেনি। যার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি।”

“প্রত্যেক নারী শ্রমিক মেডিকেল ফিটনেস নিয়ে, সব প্রক্রিয়া মেনে বিদেশ যায়। তারা আত্মহত্যা করে থাকলেও বলব যে, সেখানকার পরিস্থিতি তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। বেতন না পাওয়াসহ নানা বঞ্চনারও শিকার হচ্ছেন অনেকে, বিষয়টি কমবেশি সবার জানা। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই।”

অর্থনীতির চালিকাশক্তি প্রবাসী আয়

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশে গেছেন ৬২ হাজার ৬৩৮ জন নারী। ২০১৮ সালে বিদেশে যান এক লক্ষ এক হাজার ৬৯৫ জন নারী। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল এক লক্ষ ২১ হাজার ৯২৫ জন। প্রবাসী আয়ে নারীরাও এখন অবদান রাখছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই টাকা গত অর্থবছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) রেমিট্যান্স বাবদ বাংলাদেশ আয় করেছিল এক হাজার ৪৯৮ কোটি কোটি ১৬ লাখ ডলার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।