স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ঢাকায় নয় জঙ্গির আত্মসমর্পণ

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.01.14
ঢাকা
স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ঢাকায় নয় জঙ্গির আত্মসমর্পণ জঙ্গিবাদ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে র‌্যাব সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণকারী একজনের হাতে সনদ তুলে দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ১৪ জানুয়ারি ২০২০।
[বেনারনিউজ]

জঙ্গিবাদ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন স্ব-ঘোষিত নয় জঙ্গি। 

বৃহস্পতিবার ঢাকায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন তাঁরা। এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের হাতে সনদ তুলে দেন। 

আত্মসমর্পণকারীদের ছয়জন জামিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং তিনজন আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন বলে বেনারকে জানান র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান আশিক বিল্লাহ। তাঁদের পেশা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। 

১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এসব তরুণ–তরুণীর কেউ চিকিৎসক, কেউ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, কেউবা ছাত্র জানিয়ে অনুষ্ঠানে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার জানান, তাঁরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। 

জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চালু করা ‘ডির‌্যাডিক্যালাইজশেন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মসূচির মাধ্যমে এই নয়জন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন বলে জানান তিনি। 

জঙ্গিবাদে জড়িতদের মস্তিষ্কের বদ্ধমূল ধারণা বা মতবাদকে অস্ত্র দিয়ে নির্মূল করা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখান থেকে তাঁদের বুঝিয়ে বের করে আনা ছাড়া বিকল্প নেই। আর সেজন্য র‌্যাব ডির‌্যাডিকালাইজেশন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।” 

বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণকারীরা হচ্ছেন; সিলেটের শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪), নুসরাত আলী জুহি (২৯), কুমিল্লার আবিদা জান্নাত আসমা (১৮), আবদুর রহমান সোহেল (২৮), চাঁদপুরের মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হাসান গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), ঝিনাইদহের মো. সাইফুল ইসলাম (৩১), চুয়াডাঙ্গার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬) ও মো. সাইদুর রহমান (২২)। 

অনুষ্ঠানে তাঁদেরকে মঞ্চে ওঠানো হয়, কেউ কেউ সেখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও জানান। এই নয়জনের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে পুরনো একটি মামলা ছাড়া বাকিদের নামে কোনো মামলা নেই বলে জানান কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার। 

'ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার'

অনুষ্ঠানে ১৮ বছর বয়সী আবিদা জান্নাত আসমা জানান, তিনি ২০১৯ সালে এসএসসি পাশ করে পরিবারকে না জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় হওয়া এক যুবককে বিয়ে করে বিদেশ চলে যান। এরপর জঙ্গিবাদে যুক্ত তাঁর স্বামীর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। 

পরে দেশে ফিরলেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া জীবনের কথা তুলে ধরে আসমা জানান, “আমি ভুল করে এ পথে এসেছিলাম। ভুল বুঝতে পেরে বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করে র‌্যাবের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেছি। আশা করছি আমার স্বামীও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।” 

“আশা ছিল সে (আসমা) লেখাপড়া করে চাকুরি করবে। কিন্তু কীভাবে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো,” মন্তব্য করে অনুষ্ঠানে আসমার মা শাহিনুর সুলতানা বলেন, “আসমা ফিরে এসেছে এটি আমাদের জন্য বড়ো পাওয়া। কোনো মায়ের সন্তান যেন জঙ্গিবাদের মতো ভুল পথে পা না বাড়ায়।” 

২০০৯ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ‘ধর্মীয় ব্যাখ্যায়’ আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে অনুষ্ঠানে জানান সিলেটের ইঞ্জিনিয়ার শাওন মুনতাহা শওকত। 

তিনি বলেন, “আমি ২০১৬ পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহের কাজ করেছি। তবে নিজে কোনো নাশকতামূলক কাজ করিনি।” 

বিয়ের পরে তাঁর উৎসাহে তাঁর স্ত্রীও জঙ্গিবাদে যোগ দেন জানিয়ে শওকত বলেন, সংগঠনের পরামর্শে ২০১৬ সালে ডাক্তার স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ তিনি ঢাকায় চলে আসেন। 

অনুষ্ঠানে শওকত বলেন, “আমি সবসময় পালিয়ে বেড়াতাম। এমনকি নিরাপত্তার শঙ্কায় মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারতাম না। এভাবে বাবা-মা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে একসময় মনে হয় এটি ভুল পথ। তাই পিতা-মাতার সাথে যোগাযোগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই।” 

“আমি ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি,” জানিয়ে শওকত বলেন, “কেউ যেন এই ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়ে জঙ্গিবাদের জড়িয়ে না পড়ে।” 

আসমা ও শওকত আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন বলে বেনারকে জানান র‌্যাবের মিডিয়া শাখার প্রধান আশিক বিল্লাহ।

জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা প্রশ্নবোধক

এদিকে ডির‌্যাডিকালাইজেশন কর্মসূচি দিয়ে খুব বেশি ফলাফল আসবে না বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার। 

তিনি বেনারকে বলেন, “আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিরা আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ জঙ্গিরা জঙ্গিবাদ বাদ দিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে এমন নজির পৃথিবীতে বিরল।” 

“এটা তাঁদের টিকে থাকার কৌশল হতে পারে। সময় বুঝে এরা তাদের পুরানো জঙ্গি চেহারা দেখাতে পারে,” বলেন তিনি। 

“এর আগে অনেক জঙ্গিকে কাউন্সেলিং করে মনে হয়েছে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। কিন্তু কিছুদিন পর তারা আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আটক হয়েছে,” বলেন মোহাম্মদ আলী। 

“জঙ্গিদের পুনর্বাসনে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে,” বলে গত ৫ জানুয়ারি এক ওয়েবিনার বক্তব্যে মন্তব্য করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “সুযোগ–সুবিধা নিয়ে তাঁদের অনেকেই আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে, বিশ্বে এমন অনেক নজির রয়েছে।” 

জঙ্গিদের পুনর্বাসন সঠিক সমাধান না হলেও এটাই সম্ভাব্য সমাধান বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ নিহত হন মোট ২২ জন। তাঁদের মধ্যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেকে। 

পরদিন ২ জুলাই সকালে সেনা কমান্ডোদের উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর একজন পাচক নিহত হন। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশে জঙ্গি দমন অভিযান জোরদার হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। 

পুলিশ ও র‍্যাবের সূত্রমতে, বৃহস্পতিবারের নয়জনসহ ২০১৬ সাল থেকে র‍্যাবের কাছে এ পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন এবং পুলিশের কাছে আরো অন্তত ১৯ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছেন। স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসনের জন্য আত্মসমর্পণকারীদের অর্থসহ বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।