ঢাকায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন তাহরির আল-শামসের সদস্য গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.01.25
ঢাকা
ঢাকায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন তাহরির আল-শামসের সদস্য গ্রেপ্তার ঢাকার বসিলায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানার বাইরে পুলিশের পাহারা। ২৯ এপ্রিল ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

দেশে প্রথমবারের মতো সিরিয়া-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামস-এর এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট (সিটিটিসি)

গ্রেপ্তার মিনহাজ হোসেন (৩৮) জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। তুরস্ক অবস্থানকালে তাহরির আল-শামস এর সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মিনহাজকে শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার দারুস সালাম থানা এলাকা থেকে আটক করা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

আটকের পর তাঁর বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা হয়। রোববার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে জানিয়ে সিটিটিসির উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সোমবার থেকে তাঁর রিমান্ড শুরু হয়েছে।” 

মিনহাজের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারের কপি বেনারের কাছে রয়েছে। এজাহারে বলা হয়, মিনহাজ নব্য জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (নব্য জেএমবি) সদস্য হিসাবে কাজ করে দেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নাশকতা করার চেষ্টা করছিলেন। 

“আটক মিনহাজ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে এবং ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছে। তুরস্ক যাওয়ার আগে সে চাকরি ছেড়েছিল,” বলেন সাইফুল ইসলাম। 

এজাহারে মিনহাজের বিবরণ

মামলার এজাহারে বলা হয়, মিনহাজের বাবার বাসা ঢাকার মালিবাগে। সেখানেই তাঁর জন্ম। মায়ের চাকরির সুবাদে শৈশবে পাকিস্তান চলে যান মিনহাজ।

পাকিস্তানে লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, পাপুয়া নিউগিনিসহ একাধিক দেশ ভ্রমণ করে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

বাংলাদেশে এসে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন মিনহাজ। পাশাপাশি অনলাইনে জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সংগঠনের সাথে যোগাযোগের প্রচেষ্টা শুরু করেন। তারপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়া যাওয়ার জন্য তুরস্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন।

তুরস্কে থাকাকালে মিনহাজ সন্ত্রাসী সংগঠন হায়াত তাহরীর আল শামস এর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিরিয়া যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু সিরিয়ায় প্রবেশ করতে না পেরে গত ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসেন। 

দেশে ফিরে খুলনায় আত্মগোপন করে বাংলাদেশে অবস্থানরত সন্ত্রাসী সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন মিনহাজ।

এজাহার অনুযায়ী, মিনহাজ নব্য জেএমবির সদস্যদের সাথে মিলিত হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনার সাথে যুক্ত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

পুলিশ জানায়, গত বছর ডিসেম্বর মাসে তুরস্ক হয়ে একজন সিরিয়া ফেরত বাংলাদেশি নাগরিক দেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংযোগ

বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পর্ক নেই বলে সরকার অব্যাহতভাবে দাবি কলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আটকের ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকার স্বীকার না করলেও বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পক্ষে যুদ্ধ করতে ইরাক-সিরিয়ায় গেছে।”

হায়াত তাহরির আল-শামস-এর কোনো সদস্য এর আগে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার না হলেও, মিনহাজই বাংলাদেশে এই গোষ্ঠীর একমাত্র সদস্য নাও হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সংগঠনটির আরো সদস্য বাংলাদেশের থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।” 

তাঁর মতে, “হয়তো সে বাংলাদেশে এসেছে দলের পক্ষে সদস্য নিয়োগ করতে। অন্যথায় সে কেন বাংলাদেশে আসবে?”

তিনি বলেন, “পুলিশ বলছে, সে নব্য জেএমবি’র সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। কারণ এই সংগঠনের সাথে আদর্শগতভাবে এদের মিল রয়েছে। এর অর্থ হলো বাংলাদেশে যারা স্থানীয় জঙ্গি হিসাবে কাজ করে তাঁদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রয়েছে।” 

ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন জানায়, ২০১১ সালে ইরাক থেকে শত শত কট্টরপন্থী জঙ্গি সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে জাবাথ আল নুসরা নামক সংগঠন গঠন করে। এরা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ বিরোধী।

এই সংগঠন থেকে বেরিয়ে তারা ২০১৭ সালে হায়াত তাহরির আল-শামস গঠন করে। এদের বর্তমান অবস্থান সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ইডলিব শহরে। তুরস্কের সমর্থনে পরিচালিত এই জঙ্গি সংগঠনটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে বাসার বিরোধী জোটের সর্বশেষ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র হায়াত তাহরির আল-শামসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্রদপ্তরের ২০১৯ সালের দেশভিত্তিক সন্ত্রাস বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হায়াত তাহরির আল-শামস আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার ভাবাদর্শের অনুসারী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।