গ্রেপ্তার এড়াতেই দেশ ছেড়েছিলেন আসামে আটক বাংলাদেশি জঙ্গি

শরীফ খিয়াম
2022.03.11
ঢাকা
গ্রেপ্তার এড়াতেই দেশ ছেড়েছিলেন আসামে আটক বাংলাদেশি জঙ্গি ঢাকার একটি সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় আশপাশের এলাকায় র‍্যাব সদস্যদের পাহারা। ২৯ এপ্রিল ২০১৯।
[এএফপি]

ভারতের আসামে আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গি সন্দেহে আটক বাংলাদেশি সাইফুল ইসলাম ওরফে মোহাম্মদ সুমন চার বছর আগে গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে সুমন কখনো উগ্রপন্থার সাথে জড়িত ছিলেন না বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।

হারুন রশিদ নামেও পরিচিত সুমনের আসল নাম সুমন মিয়া, বর্তমান বয়স ৪১ বছর বলে বেনারকে জানান নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার পরিদর্শক সুরুজ উদ্দিন আহম্মদ।

সুমনের পরিবার আড়াইহাজার উপজেলার উচিৎপুরা ইউনিয়নের পূর্ব আতাদী গ্রামে বসবাস করে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “২০১৮ সালের শুরুতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অভিযানের মুখে ভৈরবদী গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ি মসজিদের জানালা ভেঙ্গে সে পালিয়ে যায়।”

“ফেসবুকে উগ্রবাদী প্রচারণার কারণেই” সুমনকে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

তবে সুমনের বাবা হাজী মো. নূরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, তাঁর ছেলের নামে কোনো মামলা ছিল না। কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে র‌্যাবকে ভুল তথ্য দিয়েছিল।

“সুমন উগ্রপন্থার সাথে কখনো জড়িত ছিল না” দাবি করে বৃহস্পতিবার নূরুল ইসলাম বলেন, “সে খুব শান্তশিষ্ট ভদ্র মেজাজের ছেলে।”

গত ৪ মার্চ আসামে গ্রেপ্তার সুমনের সাথে চার বছর ধরে পরিবারের কারো যোগাযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন ৭০ বছর বয়সী এই কাপড় ব্যবসায়ী। দেশে সুমনের চার শিশু সন্তান ও স্ত্রী রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সুমন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষা (দাওরা ও তাফসিরুল কোরআন) সম্পন্ন করে ২০১১ সালে বাড়ির কাছের ওই মসজিদে ইমাম হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন।

তাঁর পরিবারের সবাই আলেম ও মাদ্রাসাপড়ুয়া জানিয়ে নূরুল ইসলাম বলেন তাঁদের কেউই জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত না।

এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমসসহ একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম জানায়, ৪ মার্চ দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার সুমনকে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) মতাদর্শ অনুসরণকারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছে পুলিশ।

সুমন ২০১৯ সালে অবৈধভাবে আসামে প্রবেশ করে বরপেটা জেলার ঢাকালিয়াপাড়া মসজিদে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন বলে গত ৫ মার্চ সাংবাদিকদের জানান রাজ্য পুলিশের মহাপরিচালক (ডিজিপি) ভাস্কর জ্যোতি মহন্ত।

তিনি বলেন, “বরপেটা জেলাকে জিহাদি কর্মকাণ্ড এবং আল-কায়েদা ও এর সংশ্লিষ্ট সংগঠনের অবৈধ কার্যকলাপের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সে এবিটি চক্রে যোগদানের জন্য চারজনকে সফলভাবে দীক্ষিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল।”

“তারা ‘নেটওয়ার্ক’ সম্প্রসারণের জন্য আরো অনেককে প্ররোচিত করার পরিকল্পনা করছিল," বলেন তিনি।

আসামে আটক সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গির বিষয়ে নিজের মোবাইল ফোনে সংবাদ পড়ছেন ঢাকার একজন পাঠক। ১১ মার্চ ২০০২। [শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]
আসামে আটক সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গির বিষয়ে নিজের মোবাইল ফোনে সংবাদ পড়ছেন ঢাকার একজন পাঠক। ১১ মার্চ ২০০২। [শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

ভারত-বাংলাদেশের সমন্বয় জোরদার হওয়া প্রয়োজন

উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে বহুদিন ধরেই জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতাপন্থীদের সামলাতে হচ্ছে, এই সুযোগে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সেখানে কর্মকাণ্ড বিস্তারের জন্য সব সময়ই চেষ্টা করে আসছে বলে বেনারকে জানান টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক।

“আসামে এর আগেও বাংলাদেশি জেহাদি সংগঠনের অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে,” উল্লেখ করে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. পুষ্পিতা দাস বেনারকে বলেন, “আগে শুধু বোড়ো জাতিগোষ্ঠীর উগ্রপন্থার সুযোগে জঙ্গি তৎপরতা প্রসারের চেষ্টা চলত। এখন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের কারণে সেখানে যে ক্ষোভ রয়েছে, সেটাকেও কাজে লাগিয়ে মানুষকে জেহাদি কার্যক্রমে যুক্ত করার চেষ্টা চালছে।”

“বরপেটার মতো অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় জেহাদিরা সহজেই আস্তানা তৈরি করে তাদের লক্ষ্য পূরণে কাজ করে চলেছে। এ বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বয় আরো জোরদার হওয়া প্রয়োজন,” বলেন নয়াদিল্লির মনোহর পারিক্কর ইন্সটিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড এনালাইসিসের এই রিসার্চ ফেলো।

আসামে জঙ্গি তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে জানিয়ে ৬ মার্চ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, “এখানে একাধিক সন্ত্রাসী চক্র কাজ করছে।”

নয়াদিল্লির ইন্সটিটিউট ফর কনফ্লিকট ম্যানেজমেন্টের ওয়েবসাইট সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল (এসএটিপি) পোর্টালে ভারতে সক্রিয় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী হিসেবে এবিটিসহ একাধিক বাংলাদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ রয়েছে। সেখানে আসামে সক্রিয় গোষ্ঠী হিসেবে জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামও আছে।

বরপেটায় ২০১৯ সালে জুলাইতে জেএমবির চার প্রশিক্ষিত জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছিল। এছাড়া গত বছরের এপ্রিলে রাজ্যের ধুবড়ি থেকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারী নব্য জেএমবির দুইজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সুমনের বিষয়ে তথ্য চাইবে বাংলাদেশ

এদিকে ভারতে তদন্ত শেষ হওয়ার পর “সুমনের ব্যাপারে আরো অনেক ‘ইনডেপথ’ (গভীর) তথ্য পাওয়া যাবে,” জানিয়ে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার (এসপি, মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ তাঁর ব্যাপারে ভারতের কাছেও তথ্য চাইবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের মে মাসে এবিটি-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর সংগঠনটির সদস্যরা আনসার আল ইসলাম নামে তৎপর হয়। পরে ২০১৭ সালের মার্চে আনসার-আল-ইসলামকেও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

হিন্দুস্থান টাইমস জানায়, সুমন ও চার ভারতীয় সহযোগীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, নাশকতার চেষ্টা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তহবিল সংগ্রহসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে ভারতীয় দণ্ড বিধানসহ বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন, পাসপোর্ট আইন এবং বিদেশী আইনের বিভিন্ন ধারায় বরপেটা থানায় মামলা নথিভুক্ত করে ৫ মার্চ তাদের আদালতে হাজির করা হয়। অধিকতর তদন্তের জন্য তাদের সবাইকে পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।

কলকাতা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।