এক অপ্রাপ্তবয়স্কসহ সন্দেহভাজন দুই নব্য জেএমবির সদস্য গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.05.05
ঢাকা
এক অপ্রাপ্তবয়স্কসহ সন্দেহভাজন দুই নব্য জেএমবির সদস্য গ্রেপ্তার ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নব্য জেএমবি জঙ্গিদের আক্রমণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। ২ জুলাই ২০১৬।
[বেনারনিউজ]

ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আদর্শে অনুপ্রাণিত ও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (নব্য জেএমবি) দুই সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। 

বুধবার পুলিশ জানিয়েছে, আটক দুজনের মধ্যে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুল ছাত্র যে অনলাইনে নব্য জেএমবির খপ্পরে পড়ে উগ্রবাদের জড়িয়ে পড়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ওই সন্দেহভাজন জঙ্গির নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে নব্য জেএমবি গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ঘটনাস্থলে ১৭ বিদেশিসহ মোট ২০ নিরীহ মানুষকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। 

বাংলাদেশে সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী ওই আক্রমণে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান, পরে কমান্ডো অভিযানে ছয় হামলাকারী নিহত হয়। ওই ঘটনার পর থেকে র‍্যাব–পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে নব্য জেএমবি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও মাঝেমধ্যে ওই সংগঠনের কর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

বুধবার ওই দুই সন্দেহভাজন জঙ্গিকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হলে তাঁদের একজন সাকিব আহমেদ চৌধুরী ওরফে জাকিকে পুলিশ রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। 

আদালত সাকিবকে পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছে জানিয়ে ঢাকার বিচারিক আদালতে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন বেনারকে বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক অন্যজনকে টঙ্গির সেফহোমে পাঠানো হয়েছে।

“সেফ হোম থেকে তাঁকে শিশু আদালতে প্রেরণ করা হবে। সেখানে তাঁর জামিন শুনানি হবে। আদালত জামিন না দিলে তাঁকে শিশু কারাগারে থাকতে হবে,” জানান তিনি।

কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বুধবার বেনারকে জানান, ঢাকার মাতুয়াইল এলাকা থেকে সাকিব ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ওই সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। দুজনের বাড়িই সিলেট জেলায়।

তাঁরা জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ঢাকা শহরে নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনার জন্য ঘটনাস্থলে মিলিত হয়েছিল বলে জানান সাইফুল। 

তিনি আরও জানান, আটক সাকিব সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষে ইন্টারনেটে ফ্রি-ল্যান্সিং কাজে যুক্ত ছিলেন।

“অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটি সিলেট সরকারি প্রাথমিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে অনলাইনে জঙ্গিদের সাথে সে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তাঁর বাবা অনলাইনে ব্যবসা করেন। সেই সূত্রে ইন্টারনেটে ছেলেটির অবাধ বিচরণ ছিল। এরই মধ্যে সে জঙ্গিদের খপ্পরে পড়ে যায়,” বলেন সাইফুল ইসলাম।

পুলিশ জানায়, আটক দুই সন্দেহভাজন অনলাইনের মাধ্যমে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতেন। 

বাংলাদেশে প্রথম সারির জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে শায়খ আব্দুর রহমানের জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। 

সামরিক শাখার প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহী, বগুড়া, নাটোর, নওগাঁ জয়পুরহাটের কিছু এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এই সংগঠনটি।

পরে সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন আদালত প্রাঙ্গণের নৃশংস হামলা চালিয়ে কয়েকজন বিচারক ও আইনজীবীদের হত্যা করে।

২০০৭ সালে সংগঠনটি শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইর ফাঁসি কার্যকর হয়। এরপর থেকে সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে কয়েকবছর পরে আবার আল কায়েদার আদর্শ ধারণ সংগঠিত হতে থাকে। 

ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের আবির্ভাবের পর জেএমবির একটি অংশ বের হয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে নব্য জেএমবি। পরে এই জেএমবিই হয়ে ওঠে দেশবাসীর মাথা ব্যথার কারণ। 

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্যকে হত্যা করতে থাকে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার অভিজাত হোলি আর্টিজান বেকারিতে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে হত্যা করে জঙ্গিরা।

এই আক্রমণের পর পুলিশ ও র‌্যাব সারা দেশে এই সংগঠনের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। আলাদা আলাদা পুলিশি অভিযানে শতাধিক জঙ্গি নিজেদের উড়িয়ে দেয় অথবা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর হোলি আর্টিজান হামলার দায়ে অভিযুক্ত আট জঙ্গির মধ্যে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী আদালত। বেকসুর খালাস দেয়া হয় একজনকে। 

বাচ্চাদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজর রাখতে হবে

“অপ্রাপ্তবয়স্কদের ইন্টারনেটে অবাধ বিচরণ বর্তমানে বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে,” বলে বেনারকে জানান তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা।

তিনি বলেন, “করোনা মহামারির কারণে প্রতিটি স্কুলে অনলাইনে পাঠদান চলছে। এজন্য প্রত্যেকের ই-মেইল আইডি রয়েছে যেটি দিয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। আবার পাঠদানের ক্ষেত্রেও ফেসবুক ব্যবহৃত হচ্ছে।”

“এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জঙ্গিরা। তারা প্রথমে ফেসবুকে বিভিন্ন রকমের সুন্দর সুন্দর কথা, ছবি ও ভিডিও দিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সম্মোহিত করে ফেলে,” জানিয়ে তিনি বলেন, এদের মধ্যে যাদেরকে দলে ভেড়ানো সম্ভব মনে হয় তাদের সাথে জঙ্গিরা পরবর্তীতে অন্যান্য অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ তৈরি করে। 

“আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সহজে তথ্য পায় না,” এমন সব অ্যাপসই জঙ্গিরা সাংগঠনিক পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করে বলে জানান তিনি।

“জঙ্গিদের হাত থেকে অবুঝ বাচ্চাদের রক্ষা করতে পিতামাতাদের সচেতন হতে হবে। বাচ্চাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নজর রাখতে হবে,” জানিয়ে জোহা বলেন, “এমন ব্যবস্থা রয়েছে যার মাধ্যমে বাচ্চারা কোন কোন সাইটে যাচ্ছে সেগুলোর তালিকা বাবা-মার ইমেইলে চলে আসবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।