করোনা মহামারির সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.06.18
ঢাকা
200618-BD-militants-1000.jpg ২০১৬ সালের জুলাইতে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি শরিফুল ইসলামকে রায়ের পর ঢাকার আদালত থেকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ২৭ নভেম্বর ২০১৯।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যস্ত, এই সুযোগে আনসার-আল-ইসলামসহ জঙ্গি সংগঠনগুলো অনলাইনে নিজেদের কার্যক্রম জোরদার করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, তারা বসে নেই, গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৬ জঙ্গিকে।

“আনসার-আল-ইসলাম এখন সংগঠিত হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। তাদের প্রধান নেতা বরখাস্তকৃত মেজর জিয়া এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। আনসার-আল-ইসলাম বাংলাদেশে নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যস্ত,” বেনারকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন।

তাঁর মতে, আনসার-আল-ইসলাম রোহিঙ্গা নিধন, কাশ্মীরে মুসলমান হত্যার মতো বাংলাদেশিদের কাছে সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কথা বলে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে।

একই মত পোষণ করেন অন্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ বাসায় থাকছে। তারা অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করছে। কাজেই, অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে তাদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গিরা।”

“করোনাভাইরাস দেশে দারিদ্র ফিরিয়ে এনেছে। করোনাভাইরাসের কোনো ওষুধ বা টিকা নেই,” মন্তব্য করে আব্দুর রশীদ বলেন, “জঙ্গিরা করোনাভাইরাসকে আল্লাহর অভিশাপ বলে অভিহিত করে জনগণকে তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।”

তাঁর মতে, জঙ্গিরা অনলাইনে প্রচুর সক্রিয়। এছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে সবাই মাস্ক পরে চলাফেরা করা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষের কাছে না যাওয়াতে বর্তমানে জঙ্গিদের চলাচলে আগের থেকে সুবিধাজনক হয়েছে।

“আমার মনে হয়, আনসার-আল-ইসলাম আমাদের জন্য নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করতে পারে,” বলেন আব্দুর রশীদ।

তবে করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও জঙ্গিদের যে কোনো তৎপরতা রুখে দেবার সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে বলে মন্তব্য করেন অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক এম. মনিরুজ্জামান।

“অবশ্যই পুলিশ এখন কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যস্ত,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু আমরা বসে নেই।”

“বাংলাদেশ পুলিশ এখন খুবই পেশাদার বাহিনী। জঙ্গিদের যেকোনো তৎপরতা আমরা রুখে দিতে তৎপর। এই মহামারির সময়ও আমরা অনেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছি,” বলেন মনিরুজ্জামান।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে অনলাইনে জঙ্গিবাদী ধারণা প্রচার বাড়ার কথা স্বীকার করে র‌্যাবের মুখপাত্র ও পরিচালক লে. কর্ণেল মো. সারওয়ার-বিন-কাশেম বেনারকে বলেন, যে সকল জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় তাদের মধ্যে আনসার-আল-ইসলাম অন্যতম।

“জঙ্গিবাদী আদর্শ ছড়াতে তাদের সদস্যরা ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে বলে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস আল্লাহর গজব; আর এই গজব থেকে মুক্তি পেতে তাদের আদর্শ ধারণ করতে হবে,” বলেন সারওয়ার-বিন-কাশেম।

তিনি বলেন, “তবে আমরাও বসে নেই। এবছর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও আমরা পয়লা মার্চ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ৬৬ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছি।”

করোনাভাইরাস মহামারির ভেতর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিবাদী আদর্শ প্রচারে “আনসার-আল-ইসলাম, হিজবুত তাহরির, নব্য-জেএম, জেএমবি সবাই কমবেশি আছে” বলে মন্তব্য করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যাণ্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিটের উপকমিশার সাইফুল ইসলাম।

তবে “জেএমবি হোক, নব্য জেএমবি হোক অথবা আনসার-আল-ইসলাম হোক বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে এমন ক্ষমতা কারও নেই,” বলেন সাইফুল ইসলাম।

এখন পর্যন্ত দেশে আট হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ২৭ জন মারা গেছেন বলে বেনারকে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সোহেল  রানা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে মোট করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ দুই হাজার ২৯২ জন। এ পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছেন এক হাজার ৩৪৩ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৮৩ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ ৫০ হাজারের বেশি।

‘ভীতি সৃষ্টি না করে কর্মকাণ্ড চালায় আনসার-আল-ইসলাম’

আনসার-আল-ইসলাম মূলত ভারতীয় উপমহাদেশীয় আল-কায়েদার আদর্শে বিশ্বাসী বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, “তাদের কর্মপন্থা নব্য জেএমবি’র চেয়ে আলাদা।”

“নব্য জেএমবি হলি আর্টিজানে হামলা করে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে,” মন্তব্য করে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “নব্য জেএমবি ইসলামিক স্টেটের আদর্শে বিশ্বাসী। তারা জনমনে ত্রাস, আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের কার্যক্রম বিস্তার করে।”

“কিন্তু আনসার-আল-ইসলাম খুব পরিকল্পিত উপায়ে কোনো প্রকার ভীতি সৃষ্টি না করে তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে চেষ্টা করে,” বলেন তিনি।

উদাহরণ হিসেবে তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে ঢাকায় সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা জুলহাস মান্নান ও তাঁর বন্ধুকে কুপিয়ে হত্যা করার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “বাংলাদেশের অধিকাংশ সাধারণ মুসলিমদের সমকামীদের ব্যাপারে কোনো সহানুভূতি নেই। সেকারণে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জনমনে কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।”

“বরং সরকারের অনেক মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, ইসলামের কোনো প্রকার অবমাননা সরকার সহ্য করবে না। এমনকি কিছু মন্ত্রী বলেছেন, সমকামিতা বাংলাদেশে একটি ফৌজদারি অপরাধ,” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।

আনসার-আল-ইসলাম ২০১৩ সালের পর থেকে বেছে বেছে নাস্তিক, ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশকসহ উদারপন্থীদের হত্যা করে। তাঁদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকের বিচার চলমান।

তবে অভিজিৎ রায়সহ কয়েকজন ব্লগার ও প্রকাশক এবং দুজন সমকামী অধিকার কর্মীকে হত্যায় অভিযুক্ত আনসার-আল ইসলামের প্রধান মেজর (চাকুরিচ্যুত) মোহাম্মদ জিয়াউল হক এখনও ধরা পড়েননি। পুলিশ নিশ্চিত করে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলতে পারছেন না।

এমনকি মেজর জিয়া জীবিত কি না সে বিষয়েও পুলিশ নিশ্চিত নয় বলে গত বছরের অক্টোবরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম।

আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থায় ২০১১ সালে সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টায় অভিযুক্ত হন মেজর জিয়াউল হক। অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে অভুত্থানের চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ

বাংলাদেশে ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলার মাধ্যমে মূলত প্রথমবারের মতো জঙ্গি কার্যক্রমের বিষয়টি সামনে চলে আসে, যেখানে কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয় মূলত আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে ফেরা জঙ্গিরা।

এরপর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩টিতে একযোগে বোমা হামলা চালানোর পর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে জঙ্গিদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে নব্য জেএমবি ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় হলি আর্টিজান রেস্তোরায় হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ মোট ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা।

জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট আটটি দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৯ সালের নভেম্বরে নিষিদ্ধ করা হয় জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দল’কে।

অন্য সাতটি সংগঠনের মধ্যে জেএমবি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি–বি) ও শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা নিষিদ্ধ হয় ২০০৫ সালে।

২০০৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহ্‌রীরকে।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে ২০১৫ সালে নিষিদ্ধ করার পর সংগঠনটি ‘আনসার আল ইসলাম’ নামে তৎপরতা শুরু​ করে। ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও নিষিদ্ধ করে সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।