অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রম: ঢাকায় ভারতীয় নারী আটক

প্রাপ্তি রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2020.07.17
ঢাকা
200717-BD-IN-terrorism-women_1000.jpg ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির সামনে র‍্যাব সদস্যদের পাহারা। ২০১৬ সালের জুলাইতে এই রেস্টুরেন্টে নব্য জেএমবির জঙ্গিদের আক্রমণে দেশি-বিদেশি ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন। ১ জুলাই ২০১৮। [এপি]
[এপি]

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে ধর্মান্তরিত এক ভারতীয় নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন সিটিটিসি-র সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার ইমরান হোসেন।

তিনি বলেন, “আয়েশা জান্নাত মোহনা ওরফে জান্নাতুল তাসনিম ওরফে প্রজ্ঞা দেবনাথ (২৫) নামের এই নারী নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির নারী শাখার অন্যতম সদস্য।”

ইমরান হোসেন জানান, “সনাতন ধর্মাবলম্বী এই নারী অনলাইনে জেএমবির কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশে আসেন। দীর্ঘদিন ধরে গোপনে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজ করছিলেন। এর আড়ালে তিনি অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রমে নারীদের রিক্রুটমেন্ট করতেন।”

এ বিষয়ে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা মহামারির এই সময়েও জঙ্গিরা থেমে নেই। সদস্য রিক্রুট করা থেকে শুরু করে অর্থ সংগ্রহের মতো কাজও তারা এই সময়ে অনলাইনে করছে। এছাড়া জঙ্গিবাদে নারীদের সম্পৃক্ততার ঝুঁকিও বাড়ছে বলে মনে করেন তাঁরা।

জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “করোনা পরিস্থিতির এই সময়ে পুরো বিশ্ব থেমে গেলেও জঙ্গিরা নানাভাবে প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তাদের ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রচারণা বেড়েছে।”

তিনি বলেন, “জঙ্গিরা অনলাইনে কতটা অ্যাকটিভ তার প্রমাণ ভারতীয় নারীর এদেশের জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতা।”

“এমন পরিস্থিতিতে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের জগৎটাতে খুব ভালো করে নজরদারি করা দরকার,” বলেন নূর খান।

এদিকে “আমরা জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়েছি। জঙ্গিদের সন্ত্রাসী হামলা চালানোর কোনো ক্ষমতা নেই,” মন্তব্য করে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এমনকি কোভিড -১৯ মহামারির মধ্যে আমরা অনেক জঙ্গি গ্রেপ্তার করেছি।”

“তবে আমরা আত্মতুষ্ট নই,” বলেন মনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, “জঙ্গিরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তবে আমরাও বসে নেই।”

আটক ভারতীয় নাগরিক আয়েশা জান্নাত। ১৭ জুলাই ২০২০।
আটক ভারতীয় নাগরিক আয়েশা জান্নাত। ১৭ জুলাই ২০২০।
[সৌজন্যে: কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, ডিএমপি]

শিক্ষকতার আড়ালে জঙ্গিবাদ

আয়েশার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে জানিয়ে সিটিটিসি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বেনারকে বলেন, “আয়েশাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়ে শুক্রবার আদালতে তোলা হয়। আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।”

পুলিশ সূত্র জানায়, আয়েশা জান্নাত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ধনিয়াখালি থানার পশ্চিম কেশবপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রজ্ঞা দেবনাথ ২০০৯ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আয়েশা নাম গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নব্য জেএমবির নারী শাখার সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় হলে এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে আসছিলেন আয়েশা।

গ্রেপ্তারের সময় আয়েশার কাছে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট, বাংলাদেশের জন্ম নিবন্ধন সনদ, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও দুটি মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে বলে জানান ইমরান হোসেন।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, জেএমবি’র নারী শাখার প্রধান আসমানি খাতুন ওরফে আসমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন আয়েশা জান্নাত। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আসমা গ্রেপ্তার হলে নব্য জেএমবি’র নারী শাখার দায়িত্ব নেন আয়েশা। আত্মগোপনে থেকে অনলাইনে নারী ও পুরুষ সদস্য নিয়োগের কাজ করছিলেন তিনি। এমনকি দেশ-বিদেশ থেকে নব্য জেএমবির হয়ে অর্থ সংগ্রহও করতেন আয়েশা। এসব টাকা নারী সদস্যদের মোটিভেশন এবং রিক্রুটমেন্টের কাজে ব্যয় করা হতো।

পুলিশ জানায়, আয়েশা ২০১৬ সাল থেকে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করতেন। তিনি অনলাইনে একজন প্রবাসী বাংলাদেশিকে বিয়ে করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে ভুয়া কাগজপত্রও তৈরি করেছিলেন।

পুলিশ বলছে, অনলাইনে আয়েশার সাথে আরও কিছু নারী জঙ্গির যোগাযোগ রয়েছে। তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

চার বছরে একশ নারী জঙ্গি আটক

সিটিটিসি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে ১১ জন নারী নিহত হন। সন্তানকে সামনে ঠেলে দিয়ে এক নারী আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন।

নূর খান বলছিলেন, জঙ্গিবাদের শুরু থেকেই জঙ্গিদের একটি নারী স্কোয়াড তৈরি করতে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসেও এই প্রবণতা দেখা যায়।

তিনি বলেন, সাধারণত পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েই নারীরা জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয় হয়ে থাকেন।

“ধর্মের প্রতি দুর্বলতা থেকেও নারী-পুরুষ সকলেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া দুর্নীতিসহ সমাজের নানা অস্থিরতাও মানুষকে প্রলুব্ধ করে একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে,” মনে করেন এই বিশ্লেষক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।