জামিন পেয়ে পুলিশ চেকপোস্টে হামলাকারী গ্রেপ্তার

শরীফ খিয়াম
2021.11.04
ঢাকা
জামিন পেয়ে পুলিশ চেকপোস্টে হামলাকারী গ্রেপ্তার ঢাকার পুরানা পল্টন মোড়ে পুলিশ চেকপোস্টে বোমা হামলার ঘটনায় মিরপুর মাজার রোড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার নব্য জেএমবির নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবু বাছিরকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ৪ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ের পুলিশ চেকপোস্টের সামনে ‘রিমোট কন্ট্রোল’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন জামিনে কারামুক্ত নব্য জেএমবি (জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ) সদস্য আব্দুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবু বাছির (২২)।

তাঁকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারী স্থানীয় জেএমবির সামরিক শাখার ‘দায়িত্বশীল’ আখ্যা দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, বাছিরই গত বছরের ২৪ জুলাইর ওই বোমা হামলার মূলহোতা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার মাজার রোড এলাকা থেকে বাছিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ওই ‘রিমোট কন্ট্রোল’ বোমা বিস্ফোরণে কেউ হতাহত না হলেও পল্টন থানায় একটি মামলা করেছিল পুলিশ। সেই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার পর বাছিরের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সিটিটিসি কর্মকর্তারা।

পল্টনে বিস্ফোরণের ঘটনায় এর আগে ২০২০ সালের ১১ আগস্ট সিলেটে নব্য জেএমবির পাঁচজনকে ও ১০ সেপ্টেম্বর রাতে উত্তরার আজমপুর থেকে আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে “দীর্ঘ তদন্তের পর জানা যায় এই বাছিরই বোমাটি তৈরি করেন এবং বিস্ফোরণ ঘটান,” বলেন সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দাওয়াত পেয়ে ২০১৭ সালে জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবিতে বাছিত যোগ দেন।

“ফেসবুকে বেশ কিছু উগ্রবাদী কন্টেন্ট” প্রচার করার কারণে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হয়ে এক বছর তিন মাস জেলে খেটে জামিনে মুক্ত হয়ে “সে পুনরায় নব্য জেএমবির সাথে সক্রিয় হয়,” জানান আসাদুজ্জামান।

তবে তখন তাঁর বিরুদ্ধে কোন থানায় মামলা হয়েছিল, তিনি কোন কারাগারে বন্দি ছিলেন বা কীভাবে জামিন পেয়েছিলেন তা জানাতে পারেননি সিটিটিসির কর্মকর্তারা।

গত জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস) এবং সিটিটিসি আয়োজিত জঙ্গিবাদবিষয়ক এক ওয়েবিনারে জানানো হয়, আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে তিন হাজার ৯১২ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি আইনি প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হবেন।

এর মধ্যে এক হাজার ৭৩৩ জনই জামিনে মুক্ত রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪৪ শতাংশেরই সহিংস উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে কারাবন্দি ও জামিনে থাকা কমপক্ষে এক হাজার দুইশ জঙ্গিকে নজরদারিতে রাখার কথা বৃহস্পতিবার বেনারকে জানিয়েছেন এন্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার (এসপি, মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান।

সিটিটিসি প্রধানও জানান, জামিনে মুক্ত হওয়া জঙ্গিদের তাঁরা নজরদারিতে রাখেন।

“বাছির জামিন পেয়ে একটি এলাকায় চাকরি করতেন। পরে সেখান থেকে আত্মগোপনে চলে যান,” বলেন তিনি।

“প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাছির বলেছে, সে মূলত নব্য জেএমবি-র আমির মাহাদী হাসান ওরফে জনের নির্দেশে সংগঠনের সামরিক শাখায় কাজ করত,” বলেন সিটিটিসি প্রধান।

ফেসবুকে সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি বাছির বিভিন্ন ‘এ্যাপস’ ব্যবহার করে নব্য জেএমবির অন্যান্য সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে সামরিক শাখার কাজ পরিচালনা করত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি জানান, বাছিরের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায়।

যেভাবে রিমোট কন্ট্রোল বোমা তৈরি

সিটিটিসি প্রধান জানান, সংগঠনের শূরা সদস্য আবু মোহাম্মদ এর নির্দেশে বাছির প্রথমে ঢাকার মান্ডা এলাকায় একটি রুম ভাড়া করেন। আবুই টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে তাকে আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বানানোর ভিডিও পাঠান।

সেই ভিডিও দেখেই বাছির বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে আবু তাঁকে আইইডি বানানোর জন্য টাকা দিলে সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন। আইইডি তৈরির পর তাঁকে নিজের পছন্দের এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

“ওই নির্দেশ পাওয়ার পর সে গত ২৪ জুলাই নিজের তৈরিকৃত আইইডি পুরানা পল্টন মোড়ের পুলিশ চেকপোস্টের সামনে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটায়,” বলেন আসাদুজ্জামান।

পুলিশের ওপর জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সতর্কতা জারি থাকা অবস্থায় সে এই ঘটনাটি ঘটায়। পরদিন পল্টন এলাকা থেকে আরো একটি বোমা সদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়। একই মাসের ২৯ তারিখে ঢাকার পল্লবী থানার ভেতর বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পর অনলাইনে জিহাদি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স জানায়, আইএস এর দায়িত্ব স্বীকার করেছে।

এর আগে ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামে পুলিশ বক্সে বোমা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন আহত হওয়ার পরদিন হামলার দায় স্বীকার করে বার্তা দেয় আইএস।

তবে বাংলাদেশে আইএস এর উপস্থিতি নেই বলে বরাবর দাবি করে আসছেন কর্মকর্তারা।

জামিনে বেরিয়ে আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে

সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি প্রধান জানান, জামিনে বেরিয়ে কথিত জিহাদের নামে বোমা হামলায় জড়িয়ে পড়ছে অনেক জঙ্গি।

অপরাধ বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ উমর ফারুকের মতে, কারাগারগুলোকে “সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলা গেলে হয়তো আমরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতাম।”

“অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে যে দৃষ্টিতে দেখা হয়, কারাগারগুলোয় বন্দিদেরও একই দৃষ্টিতে দেখা উচিত,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “জঙ্গিদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য কারাগারগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত।”

“এক্ষেত্রে ‘সাইকোলজিস্ট’ নিয়োগ করে তাদের ‘কাউন্সিলিং’ ও ‘মোটিভেশনাল থেরাপি’-র মাধ্যমে তাদের মানসিক উন্নয়ন সবচেয়ে জরুরি। জীবনের বাস্তবিক উপলদ্ধিতে পৌঁছানো গেলে তাদেরকে জঙ্গিবাদের কবল থেকেও মুক্ত করা সম্ভব,” যোগ করেন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক।

পশ্চিমবঙ্গে আটক বরিশালের জঙ্গি

জেএমবির জঙ্গি সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মল্লিকপুরের পাঁচঘড়া থেকে মঙ্গলবার গভীর রাতে আব্দুল মান্নান বাচ্চু নামের এক বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারের পর ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) জানিয়েছে, তাঁর বাড়ি বরিশালের চাঁদসী।

গত বুধবার তাঁকে আদালতে তোলা হলে বিচারক ৮ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন জানিয়ে এনআইএ-র কৌসুলি শ্যামল ঘোষ বেনারকে বলেন, “জেএমবির সঙ্গে আব্দুলের সম্পর্ক রয়েছে বলে আদালতে জানানো হয়েছে। সে এখানে কী করত তা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।”

এনআইএ জানিয়েছে, প্রায় চার বছর ধরে মান্নান ভারতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। তাঁর কাছ থেকে ভারতের ভুয়া পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ও নানা নথিসহ মোবাইল ফোন ও বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

কলকাতা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।