জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে অনলাইন প্রচারণা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রিমান্ডে

শরীফ খিয়াম
2021.11.15
ঢাকা
জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে অনলাইন প্রচারণা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রিমান্ডে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের পক্ষে অনলাইন প্রচারণার দায়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার হাসিবুর রহমানের (মাঝখানে) সাথে ডিএমপি কর্মকর্তারা। ১৫ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

জঙ্গিগোষ্ঠীর অনলাইন প্রচারণায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইনের ছাত্র হাসিবুর রহমানকে (২১) গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ইন্টেলিজেন্স এ্যানালাইসিস বিভাগের বিশেষ অভিযানে আব্দুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে রোববার তাঁকে আটক করা হয়।

অভিযানের তত্ত্বাবধানে থাকা সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের উপ কমিশনার (ডিসি) আব্দুল মান্নান বেনারকে জানান, ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানায় হাসিবুরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়, আদালত পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।

এর আগে দুপুরে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “একুশ বছরের এই তরুণ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের অনলাইন দাওয়াহ্ শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল।”

হাসিবুর গ্রেপ্তার হওয়ায় জঙ্গিদের অনলাইন কার্যক্রম কমপক্ষে ৮০ শতাংশ কমে আসবে বলেও দাবি করেন এই কর্মকর্তা। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী স্থানীয় ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর একই শাখার আরো দুই সক্রিয় সদস্য জোবায়দা সিদ্দিকা নাবিলা ও আল আমিন সিদ্দিকীকে সম্প্রতি আটকের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

গত ২৬ আগস্ট ঢাকার বাড্ডা থেকে জোবায়দা এবং ৬ অক্টোবর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আল-আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে বেনারকে জানান সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আতিকুর রহমান চৌধুরী।

“আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা অফলাইনে কোণঠাসা হয়ে অনলাইনে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। দাওয়াতি শাখার এই তিনজনকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আমরা তাদের সেই চেষ্টা নস্যাৎ করতে সফল হয়েছি,” বলেন সিটিটিসি প্রধান।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, হাসিবুরের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইলে বিভিন্ন উগ্রবাদী কন্টেন্ট পাওয়া গেছে। সে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আনসার আল ইসলামের মতাদর্শের বিভিন্ন বক্তব্য প্রচার করত।

“সে কথিত সশস্ত্র জিহাদের অপরিহার্যতা বর্ণনা করে বিভিন্ন ‘পোস্ট’ দেয়ার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সহিংস উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করত,” বলেন আসাদুজ্জামান।

কারাগারে আটক আনসার আল ইসলাম সদস্যদের জামিনের জন্য হাসিবুর গোপনে ‘মোবাইল ব্যাংকিংয়ের’ মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ এবং সেগুলো তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিত বলেও জানান তিনি।

সিটিটিসির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্র হাসিবুর পটুয়াখালীর মহিপুর এলাকার হাবিবুর রহমানের ছেলে। তার পরিবার সম্পর্কে আর কোনো তথ্য দেয়নি পুলিশ।

যেভাবে জঙ্গি হয়ে ওঠে হাসিবুর

সিটিটিসি প্রধান জানান, ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে হাসিবুর সহিংস জঙ্গিবাদের আদর্শে দীক্ষিত হয়। আনসার আল ইসলাম, আল কায়েদা ও তালেবানদের মতবাদ প্রচারকারী দুটি ফেসবুক আইডির সাথে সংযুক্ত হয়ে সে তাদের বিভিন্ন ওয়েবসাইট সম্পর্কে জানতে পারে।

নিয়মিত ওইসব সাইটে প্রবেশ করে হাসিবুর সহিংস উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধকারী অডিও, ভিডিও ও পিডিএফ বইয়ের সন্ধান পায় এবং ক্রমে তাদের মতাদর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। 

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ‘আযযাম আল গালিব’ নামে ফেসবুক আইডি ও টেলিগ্রাম চ্যানেল খুলে আনসার আল ইসলাম ও আল কায়েদার মতাদর্শ সমর্থন করে অনলাইনে লেখালেখি এবং রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার শুরু করে।

সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী, টেলিগ্রামে একই মতাদর্শ প্রচারের সাথে জড়িত জোবায়দা ও আল আমিনের সাথে যোগাযোগ হয় তাঁর। বিভিন্ন সময় উগ্রবাদী মতবাদ ছড়ানোর জন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তার একাধিক আইডি নিষ্ক্রিয় করলেও হাসিবুর থেমে ছিল না।

উল্লেখ্য, হামলা ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে আলোচনায় আসা জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম(এবিটি) ২০১৩ সালের মে মাসে নিষিদ্ধ হয়। এরপর সংগঠনটির সদস্যরা আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করলে ২০১৭ সালের মার্চে এটিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।

ব্লগার, লেখকসহ বিভিন্ন হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই জঙ্গি সংগঠনের নাম।

‘ই-টেররিজম’ এর ঝুঁকিতে বিশ্ব

পুলিশ সদরদপ্তর ও আদালতের নথির বরাত দিয়ে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন গত ১ সেপ্টেম্বর জানায়, হত্যা ও জঙ্গিবাদের অভিযোগে দায়ের করা ৭৬ টি মামলায় ২০১৩ থেকে মোট ৩৫০ জন এবিটি কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে,

যাদের মধ্যে ১৪৮ জন জামিন পেয়েছে এবং জামিনপ্রাপ্ত ১৭ জন মুক্তির পর থেকে নিখোঁজ।

“কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে অনলাইনভিত্তিক জঙ্গি কার্যক্রম কমানো যাবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আসলে এটা কমার সুযোগ নেই। বরং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে এটা দিন দিন বাড়তেই থাকবে,” বেনারকে বলেন অপরাধ বিশ্লেষক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক।

জঙ্গিরা অনলাইনে বারবার তাদের যোগাযোগ ও প্রচারণার কৌশল পরিবর্তন করে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা বিভিন্ন প্রতীকী ভাষাই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাড়ার সুবাদে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহারেও তারা বেশ এগিয়ে আছে।”

“তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শীদের মগজ ধোলাই করে বা নানা লোভ দেখিয়ে জঙ্গিরা নিজেদের দলে টানছে, এমন নজিরও কিন্তু রয়েছে। ওই বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে তারা এমনভাবে কর্মকাণ্ড চালায়, যাতে তাদের চিহ্নিত করা না যায়,” বলেন তিনি।

বর্তমানে সারাবিশ্ব ‘ই-টেররিজম’ অর্থাৎ অনলাইনভিত্তিক জঙ্গি-হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য জঙ্গিরা এমন হামলা চালানোর চেষ্টা করছে।”

এক্ষেত্রে বাংলাদেশি জঙ্গিদের কৌশলগত জায়গাগুলো চিহ্নিত করা প্রাথমিকভাবে খুবই কঠিন জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো ঘটনা ঘটলে তখন হয়তো আমরা জানতে পারব তারা কীভাবে এগোচ্ছে।”

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, “অনলাইন জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে অনলাইন দিয়েই মোকাবেলা করার কথা ভাবতে হবে। ‘এন্টি ই-টেররিজম’ চালু করতে হবে। অর্থাৎ জঙ্গিবাদে নিরুৎসাহিত করার মতো প্রচুর কন্টেন্ট অনলাইনে প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।