সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার দায়ে এক বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার ও ১৫ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুর

জেসমিন পাপড়ি
2020.11.24
ঢাকা
201124_bangladeshi_Deported_singapore.jpg সিঙ্গাপুরে একটি নির্মাণ সাইটে কাজ শুরুর আগে ব্রিফিং শুনছেন ভারতীয় ও বাংলাদেশি শ্রমিকরা। ২৪ মার্চ ২০১৬।
[রয়টার্স]

সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে চলতি মাসে একজন বাংলাদেশি শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহিংস ও সাম্প্রদায়িক পোস্ট দেওয়ায় ১৫ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, আটক বাংলাদেশির নাম আহমেদ ফয়সাল (২৬)। গত ২ নভেম্বর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে (আইএসএ) তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফয়সল ধর্মীয় চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটাতে চেয়েছিলেন বলে সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে।

সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ জানায়, ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই নির্মাণ শ্রমিক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁরা ফ্রান্সে হামলার প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে— এমন কিছু পোস্ট দিয়েছেন। একই অভিযোগে একজন মালয়েশিয়ান নাগরিককেও দেশে পাঠানো হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষ জানায়, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে দেশটির নিরাপত্তা সংস্থা এ বিষয়ে বিশেষ সতর্ক অবস্থানে ছিল।

যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অভিযুক্ত পোস্টের বিষয়বস্তু কিংবা কবে ওইসব শ্রমিকদের দেশে পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানায়নি সিঙ্গাপুর।

অবগত নয় বাংলাদেশ

সিঙ্গাপুর থেকে শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর বিষয়ে একেবারেই অবগত নন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বেনারকে জানান, “সিঙ্গাপুর থেকে ১৫ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি পুলিশ মঙ্গলবার পর্যন্ত অবহিত নয়।”

তিনি বলেন, সেখানে আটক বাংলাদেশির বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হবে।

“এ বিষয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কিছুই জানি না। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকেও আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি,” বেনারকে বলেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মোজাফফর আহমেদ।

তবে এসব বাংলাদেশি কর্মীরা “আসলেই প্রকৃত অপরাধী কি না” সে সম্পর্কে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে “একটা স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া উচিত,” বলে মনে করেন বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার।

অভিবাসী শ্রমিকেরা প্রচণ্ডভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষ জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “তাঁদের বেশিরভাগই স্বল্প শিক্ষিত, ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেও অনেকে জানেন না।”

“তাঁরা লাইক, শেয়ার বুঝে দেন কিনা—এর পরিষ্কার চিত্র নেই। অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে যারা দেশে টাকা পাঠানো, ঋণ পরিশোধ—এসব নিয়ে চিন্তিত তাঁদের পক্ষে টেররিস্ট হয়ে ওঠা আসলেই কতটুকু স্বাভাবিক? সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে তো এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “সিঙ্গাপুরে এটা বারবার হচ্ছে মানে নিশ্চয় তথ্যের ঘাটতি আছে। সিঙ্গাপুরে অভিবাসী কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমের পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার ছাড়া বিনোদনের কিছু নেই; এটাও একটা কারণ হতে পারে।”

“এ বিষয়ে সরকারও কিছু না বলার অর্থ প্রবাসীদের কোনো ভয়েস নেই। সরকারকে সঠিক তথ্য যাচাই করতে হবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারসহ জঙ্গিবাদে জড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করতে হবে,” বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, ইসলামের মহানবীকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের ব্যঙ্গচিত্র দেখানোয় এক শিক্ষককে হত্যা করা হয়।

পরে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। এরপর থেকেই পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ তীব্র হয়।

দেশে ফিরে হামলার পরিকল্পনা ছিল ফয়সালের

সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ পরিচালিত প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ফয়সাল আইএসের খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে সশস্ত্র সহিংসতার পক্ষে উস্কানিমূলক কথাবার্তা প্রচার করতেন তিনি।

বিবৃতিতে বলা হয়, গত বছরের মাঝামাঝিতে সিরিয়ায় খিলাফত প্রতিষ্ঠায় লড়াইরত আরেকটি জঙ্গি গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রতি অনুগত হন ফয়সাল। জঙ্গি গোষ্ঠীটিকে তিনি অনুদানও পাঠান।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আল-কায়েদা এবং সোমালিয়াভিত্তিক আল-শাবাবসহ অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ফয়সাল।

বিবৃতিতে বলা হয়, ইসলামের কথিত শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সিরিয়া ছাড়াও কাশ্মিরে যেতে চেয়েছিলেন ফয়সাল। অনলাইনে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর ভিডিও দেখে এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি।

এমনকি দেশে ফিরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালাতে ফয়সাল ভাঁজ করা যায় এমন কয়েকটি ছুরি কিনে রেখেছিলেন।

তবে ফয়সাল সিঙ্গাপুরে সশস্ত্র হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানায় দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২৬ বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।