বিশেষজ্ঞদের মতে, জঙ্গি শামিমা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেতে পারেন

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.02.11
ঢাকা
200211_Shamima_Citizenship_1000.jpg যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় আইসিসে যোগ দেয়া শামিমার ছবি দেখাচ্ছেন তাঁর বড়ো বোন রেনু বেগম। লন্ডন, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
[এএফপি]

যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্য শামিমা বেগম (২০) আবেদন করলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে বাংলাদেশ সরকারের মতে, কোনোভাবেই তাঁকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

“যেহেতু শামিমার বাবা বাংলাদেশি নাগরিক, এ কারণে আমাদের বর্তমান নাগরিকত্ব আইন (১৯৫১) অনুযায়ী আবেদন করলে শামিমা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেতে পারেন,” বেনারকে বলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ।

তিনি জানান, নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বাবা অথবা দাদা বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করলে তিনি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেতে পারেন।

“তবে নাগরিকত্ব দেয়া না দেয়া সরকারের সিদ্ধান্ত,” বলেন ব্যারিস্টার শফিক।

এদিকে শামিমাকে কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে গ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শামিমা বাংলাদেশি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন “আমাদেরও অধিকার আছে তাঁর আবেদন বাতিল করার।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্য সন্ত্রাসের দায়ে যার নাগরিকত্ব বাতিল করেছে তাঁকে আমরা কেন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেবো?”

“শামিমা বাংলাদেশি নাগরিক নন। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। তিনি জঙ্গি আইএস গোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। আমরা তাঁকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেবো না,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত তাঁকে তাঁদের দেশে নিয়ে বিচার করা।”

শামিমা কখনো বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চাননি বলে বেনারকে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম।

এদিকে শামিমার বিষয়ে ‘বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান সম্পর্কে’ খোঁজখবর রাখছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন শামিমার বাবা আহমদ আলী।

আহমদ আলী বর্তমানে তাঁর নিজ জেলা সুনামগঞ্জে রয়েছেন। শামিমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য যুক্তরাজ্যের আরেকটি আদালতে আপিল করা হবে বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, যুক্তরাজ্যে তাঁর মেয়ের আইনজীবীরা যেভাবে বলবেন, তাঁরা সেভাবেই এগোবেন।

“সলিসিটার যেভাবে বলবেন, সেভাবেই সবকিছু হবে। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক। আইনি প্রক্রিয়ায় আরও একটি ধাপ বাকি রয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি,” বেনারকে বলেন আহমদ আলী।

তবে বাংলাদেশে ফিরলে তাঁর মেয়ের সর্বোচ্চ কী সাজা হতে পারে সে বিষয়েও জানতে চান আহমদ আলী।

বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান ও জন্মসূত্রে যুক্তরাজ্যের নাগরিক শামিমা বেগম ২০১৫ সালে ১৫ বছর বয়সে আরও দুই ব্রিটিশ কিশোরীর সাথে লন্ডন থেকে পালিয়ে আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি নেদারল্যান্ডের নাগরিক এক আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন অভিযানে আইএস কোনঠাসা হয়ে পড়লে এবং কুর্দি বাহিনীর হাতে তাঁর স্বামী বন্দি হলে তাঁকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে পাওয়া যায়।

জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার দায়ে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ওই মাসেরই শেষ দিকে শামিমার নাগরিকত্ব বাতিল ঘোষণা করে।

গত সপ্তাহে ব্রিটেনের একটি আদালত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আইনসিদ্ধ বলে রায় দিয়ে বলেছে, শামিমা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেতে পারেন।

আহমদ আলীর চার কন্যা সন্তানের মধ্যে শামিমাই ছোট। শামিমা এখন সিরিয়ার আল রোজ কারাগারে আছেন।

অপর তিন মেয়েকে নিয়ে আহমদ আলীর স্ত্রী আসমা আক্তার পূর্ব লন্ডনে আছেন। আসমা আক্তার ব্রিটিশ নাগরিক।

রাষ্ট্রহীন রাখা যাবে না

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “শামিমা আইএস গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে ভুল করেছে। একটি অপরাধ করার কারণে তাঁকে রাষ্ট্রহীন রাখা যাবে না। কোনো মানুষকে রাষ্ট্রহীন করার ফলাফল মারাত্মক হয়। আমি আশা রাখি যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ সরকার এই সত্য উপলব্ধি করবে।”

“কোনো নাগরিককে রাষ্ট্রহীন করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন,” যোগ করেন তিনি।

নূর খান বলেন, “শামিমাকে যদি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেয়া হয় তাহলে তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি বলতে পারেন, আইএস’র মতো জঙ্গি সংগঠন মানুষের কোনো উপকারে আসে না।”

“তাঁর এ ধরনের বক্তব্য যুবক–যুবতীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি,” বলেন নূর খান।

কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কোরআন ও ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক হাফেজ এবিএম হেজবুল্লাহ বেনারকে বলেন, “ইসলামিক স্টেটের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই—এই বিষয়টি না বুঝে সেখানে যোগ দিতে পারে শামিমা। কোরানের বিধান অনুযায়ী, কোনো মানুষ যদি কোনো অপরাধ করে প্রকৃতই অনুতপ্ত হয় তাহলে সে মাফ পেতে পারে। ইসলামিক বিধান অনুযায়ী, শামিমাকে মাফ করা যেতে পারে।”

তবে ইসলামি চিন্তাবিদ মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বেনারকে বলেন, “এটি সত্য একজন অনুতপ্ত ব্যক্তি মাফ পেতে পারে। তবে শামিমা যে প্রকৃতই অনুতপ্ত সেটি বোঝা যাবে কীভাবে? সে কি প্রকৃতই অনুতপ্ত? নাকি বাঁচার কৌশল?”

তিনি বলেন, “শামিমার নাগরিকত্ব বাতিল করে সঠিক কাজ করেনি যুক্তরাজ্য সরকার। যুক্তরাজ্যের উচিত তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল না করে বিচার করা।”

“শামিমা রাষ্ট্রহীন হতে পারে না,” মন্তব্য করে ব্যারিস্টর শফিক আহমদ বলেন, “যেহেতু ব্রিটিশ সরকার নাগরিকত্ব বাতিল করেছে সেহেতু শামিমার পরিবারের উচিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে তার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা।”

তিনি বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি যে, আইএস গোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার জন্য এখন অনুতপ্ত শামিমা। সুতরাং, বাংলাদেশ সরকারের উচিত শামিমাকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেয়া।”

“তবে তাঁকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে,” যোগ করেন ব্যারিস্টার শফিক।

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের সাথে শামিমার বাংলাদেশি নাগরিকত্বের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকার যুক্তরাজ্য দূতাবাসের কাছে মন্তব্য চাওয়া হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

ঢাকা থেকে প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রাপ্তি রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।