ডাকাত ধরতে গিয়ে দুই জঙ্গি গ্রেপ্তার

প্রাপ্তি রহমান
2019.03.04
ঢাকা
190304_HUZI_story_620.jpg ঢাকায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা বিভাগের সংবাদ সম্মেলন। ৪ মার্চ ২০১৯।
[প্রাপ্তি রহমান/বেনারনিউজ]

পুলিশের কাছে তথ্য ছিল একদল ডাকাত ঢাকার ধোলাই পাড়ের পূবালী ব্যাংকে ডাকাতি করতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)র অভিযানের উদ্দেশ্যও ছিল ডাকাত দলটিকে হাতেনাতে ধরা। তবে শেষ পর্যন্ত ওই দলে তারা খুঁজে পায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ–বাংলাদেশ (হুজি–বি)র দুই সদস্যকে।

হুজি–বির ওই দুই সদস্যের নাম হাফিজ ওরফে খালিদ ওরফে ইব্রাহীম গাজী ও মামুনুর রশিদ ওরফে বাচ্চু মোল্লা।

সোমবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, হুজির দুই সদস্য জানান তাঁরা কারাগারে থাকা জঙ্গি নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং টাকা–পয়সা উদ্ধার হয়েছে।

“কাশিমপুর কারাগারে থাকা ওই জঙ্গির নাম উজ্জ্বল। সে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। উজ্জ্বলকে যেকোনো উপায়ে কারাগার থেকে বের করে আনা ও সংগঠন চালানোর জন্য তারা ডাকাতিতে জড়িয়েছিল,” আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন।

তিনি জানান, ডাকাতির ৩০ শতাংশ টাকা তারা সংগঠনের কাজে ব্যবহার করে বলেও জানিয়েছে।

জঙ্গিদের কাছ থেকে ১টি একে .২২ বোরের রাইফেল, ১টি পাইপ গান, ৮ রাউন্ড গুলি, জিহাদি বই, ১০ কেজি গান পাউডার ও সাড়ে ৩ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

হরকাতুল জিহাদ- বাংলাদেশ (হুজি-বি) ২০০৫ সাল থেকে নিষিদ্ধ। আফগান ফেরত মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্ররা নব্বই এর দশকে এই নামে বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৯৯ সালে কবি শামসুর রাহমান হত্যাচেষ্টা, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ও ২০০৪ সালে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা ও একই বছর তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার জন্য এই সংগঠনটি দায়ী ছিল।

ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টার দায়ে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল হুজি–বির প্রধান মুফতি হান্নানকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছিল এর মধ্য দিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীটির তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে।

নতুন করে হুজি–বির এই তৎপরতা সংগঠনটির দিকে বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কথা হচ্ছিল, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান না থাকা মানে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাওয়া নয়।

“সন্তুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। কারণ মতাদর্শ কখনো নিশ্চিহ্ন হয় না। তারা সংগঠন চালানোর জন্য লুটপাটের মতো কাজে আগেও জড়িয়েছে। এখন যেটা করতে হবে সেটা হলো নজরদারি, যেন তারা সংগঠিত হতে না পারে,” সাখাওয়াত হোসেন বলেন।

যা ঘটেছে

পুলিশ জানায়, গত ৩ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর ধোলাই পাড় মোড়ের কাছে এশিয়া জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে তারা অভিযান চালায়।

অভিযানে তারা ১২ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। এই দলের প্রধান মোফাজ্জল হোসেন ওরফে বড় ভাই ওরফে দাদা ওরফে দাদু। গ্রেপ্তার অন্যরা হলো: মো. জহির উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে চৌধুরী, মো. আতিকুর রহমান, মো. মনিরুজ্জামান ওরফে নয়ন, লাড্ডু মোল্লা, কাইয়ুম শিকদার, আলাউদ্দিন শেখ, মুন্সি খসরুজ্জামান ওরফে মেজর, মো. জাহাঙ্গীর হাওলাদার, সুব্রত দাস, মিন্টু কর্মকার ও অলিউল্লাহ হাওলাদার ওরফে অলি।

গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে দুটি ৯ এমএম পিস্তল, দুটি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ৩৩ রাউন্ড গুলি, ১টি চাপাতি, ১টি কাটার, ৩টি হেক্সো ব্লেড, ১টি স্লাই রেঞ্জ, ২টি প্লাস, ২টি স্ক্রু ড্রাইভার, ১টি স্কচ টেপ, ৫টি কালো কাপড়ের মুখোশ, ১টি ছোরা ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি পিকআপ উদ্ধার হয়।

ডাকাত দলের সদস্যদের যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তখন, এক ডাকাত আতিকুর রহমান জানান তাঁর বাসা রামপুরায়। সেখানে আরও আগ্নেয়াস্ত্র আছে।

ওই রাতেই পুলিশ রামপুরায় আতিকের বাসায় অভিযান চালায়। ওই অভিযানে গিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জঙ্গি সংগঠন হুজি দুই সক্রিয় সদস্য হাফিজ ওরফে খালিদ ওরফে ইব্রাহীম গাজী ও মামুনুর রশিদ ওরফে বাচ্চু মোল্লাকে।

ডাকাত দলটি জানায়, তারা এর আগেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নয়টিরও বেশি ডাকাতি করেছে। এমনকি গত ১৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে ডাকাতি চেষ্টাকালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। ওই ঘটনায় পুলিশের এক সদস্য বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।

পুলিশ জানিয়েছে এর আগে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করেছে। তারা বিভিন্ন মেয়াদে জেলও খেটেছে।

রামপুরা থানার উপপরিদর্শক নজরুল ইসলাম জানান, এই ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে।

“যাত্রাবাড়ী থানায় ২টি ও রামপুরা থানায় ১টি মামলা রুজু হয়েছে। রামপুরা থানার মামলাটি দায়ের হয়েছে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে, কারণ এখান থেকে জঙ্গি ও অস্ত্র দুই–ই উদ্ধার হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করবেন গোয়েন্দারা,” নজরুল ইসলাম বলেন।

জঙ্গিরা আগেও ডাকাতিতে জড়িয়েছে

এর আগেও ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের কাঠগড়া শাখায় জঙ্গিরা গুলি করে ও কুপিয়ে আটজনকে হত্যা করে। গ্রাহক বেশে তারা ব্যাংকে ঢুকেছিল। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘটনাস্থলের কাছে আমতলায় ৫ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৫ টাকাভর্তি একটি ব্যাগ উদ্ধার হয়।

ওই ঘটনার এক বছরের মাথায় ছয় জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার একটি আদালত। একই সঙ্গে আরো একজনকে যাবজ্জীবন আর দুজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তাঁরা বলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডের তহবিল সংগ্রহই ছিল ডাকাতির উদ্দেশ্য।

গত বছরের এপ্রিলে বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার পাঁচ জেএমবি সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায় ছিনতাই-ডাকাতি করে সংগঠনের জন্য তারা অর্থ সংগ্রহ করছে। এই অর্থ তারা জঙ্গিদের মামলা চালানো, পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া ও জেএমবির সাংগঠনিক নানা কাজে ব্যবহার করছিল। এভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা মানুষও খুন করছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।