জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা; আক্রমণকারীর এক সহযোগী শনাক্ত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী ও শরীফ খিয়াম
2018.03.05
ঢাকা
ড. জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে ঢাকায় ব্লগারদের মৌন মানববন্ধন। ড. জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে ঢাকায় ব্লগারদের মৌন মানববন্ধন। ৫ মার্চ ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

জনপ্রিয় সাহিত্যিক ড. জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণকারী ফয়জুর রহমান ফয়জুলের এক সহযোগীকে পুলিশ শনাক্ত করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

ফয়জুল একা আক্রমণ করতে যায়নি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “আক্রমণের আগে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার সহযোগীকে পুলিশ শনাক্ত করেছে। খুব অচিরেই তাকে ধরা হবে।”

তবে আক্রমণকারী ফয়জুল কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য তা এখনো জানা যায়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পুলিশ তদন্ত করছে। সে কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য সে ব্যাপারে দুই এক দিনের মধ্যেই নিশ্চিত হতে পারব।”

তবে জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী হয়ে ফয়জুল ড. জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে বলে জানান র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক কর্নেল আলী হায়দার।

শনিবার রাতের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে রোববার বিকেলের প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, “ফয়জুল র‌্যাবকে বলেছে, ‘ড. ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছে। তাঁর লেখা পড়ে তরুণেরা নাস্তিক হচ্ছে।”

তবে জাফর ইকবালের লেখা দুইশোটি বইয়ের কোথাও ইসলামের বিরুদ্ধে একটিও লাইন নেই বলে সোমবার মিডিয়ার কাছে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক।

“সাধারণত এমন ঘটনায় তারা একা থাকে না। নিশ্চয়ই তার সঙ্গে অন্যরা ছিল, যারা কৌশলে পালিয়ে গেছে,” এক প্রশ্নের উত্তরে মন্তব্য করেন আলী হায়দার।

ফয়জুল ও আরও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে বলে জানান জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুর রহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “গণধোলাইয়ের শিকার হওয়া ফয়জুলকে ওসমানী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে।”

“সে আগের চেয়ে সুস্থ হয়ে উঠছে। তবে তার কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য মেলেনি,” বলেন তিনি।

এদিকে হামলার ঘটনায় মোট তিনজনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়া।

 

ফয়জুলের বাবা-মায়ের আত্মসমর্পণ

“হামলাকারী ফয়জুলকে রোববার বিকেলেই আমাদের হেফাজতে দেয় র‌্যাব। পরে রাত পৌনে ১১টার দিকে তার বাবা আতিকুর রহমান এবং মা মিনারা বেগম আত্মসমর্পণ করেন,” বেনারকে বলেন ওসি শফিকুর রহমান।

তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, জানান তিনি।

শনিবার রাতেই ফয়জুলের সিলেট শহরের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। ওই সময় বাসা তালাবন্ধ অবস্থায় পেয়ে পাশের আরেকটি বাসা থেকে তার মামা ফজলুর রহমানকে আটক করা হয় বলে জানান শফিকুর রহমান।

রোববার সকালে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের জগদলে ফয়জুলদের গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখানেও কাউকে না পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে ফয়জুলের চাচা আব্দুল কাহেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।

তবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন র‌্যাবের সিও আলী হায়দার।

তিনি জানান, “আর ফয়জুল সিলেটের জিন্দাবাজারের ‘মঈন কম্পিউটার’ নামের যে দোকানে কাজ করত, সেটির স্বত্বাধিকারীকে আটক করা হয়নি, জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”

“ফয়জুল বলছে সে দাখিল পাস। আলিম পড়ার সময় পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তবে কোথায় সে দাখিল পড়েছে, সে সম্পর্কে একেকবার একেক তথ্য দিচ্ছে,” বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা আলী হায়দার।

জাফর ইকবালের পাশে প্রধানমন্ত্রী

সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ড. জাফর ইকবালকে দেখতে যান বলে বেনারকে জানান তাঁর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।

এর আগে রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “হামলাকারী কারা এটা হামলার ধরন থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। যারা এই ঘটনাগুলো ঘটায় তারা ধর্মান্ধ।”

“এই বাংলাদেশে কোনো রকম সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আমরা চলতে দেবো না,” তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে রোববার ঢাকা সিএমএইচের চিকিৎসকেরা সাংবাদিকদের জানান, ড. জাফর ইকবালের মাথা, পিঠ ও হাতে ছুরির ছয়টি জখম রয়েছে। তিনি বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত, তবে পুরো সুস্থ হতে তার কয়েক দিন সময় লাগবে।

“বর্তমানে তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞান, সচেতন ও আশঙ্কামুক্ত আছেন,” বলেন সিএমএইচ এর সার্জন জেনারেল মুনশি মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান।

মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকাই কারণ

ইসলামি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার থাকাই অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে এই শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রীকে মুঠোফোনের খুদে বার্তায় হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ওই বছর থেকেই তাঁকে পুলিশি নিরাপত্তা দিচ্ছে সরকার।

এর আগেও জঙ্গিগোষ্ঠী ঘোষিত টার্গেট কিলিংয়ের হিট লিস্টে ড. জাফর ইকবালের নাম এসেছে।

“ড. জাফর ইকবাল ইসলামি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। ইতিপূর্বে তাদের হাতে নিহত লেখক-প্রকাশক হত্যার ঘটনাগুলোয়ও তিনি নীরব ছিলেন না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণজাগরণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন,” বেনারকে বলেন প্রগতিশীল আন্দোলনের সক্রিয় মুখ শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবীন আহসান।

“ফলে ড. জাফর ইকবালের ওপর এই যে আক্রমণ, এটা সরাসরি মুক্তবুদ্ধি চর্চার লড়াই বা লেখক-প্রকাশক, সবার ওপর আক্রমণ। গত তিন-চার বছর ধরে যে ধারাবাহিক আক্রমণ বাংলাদেশে হয়ে আসছে তার সর্বশেষ শিকার তিনি” বলেন রবীন।

রবীন মনে করেন লেখক হিসেবে তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ড. ইকবাল শিশু-কিশোরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস লিখেছেন, সেটার জন্যও তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।