সরকারের মৌলবাদী তোষণে উৎসাহিত হচ্ছে জঙ্গিরা: মৃত্যুর হুমকি পাওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ

শরীফ খিয়াম
2018.03.06
ঢাকা
ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ মিছিল। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ মিছিল। ৪ মার্চ ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

সরকার নিয়মিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করলেও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নীতি ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সাথে সরকারের আপোষের কারণেই জঙ্গিরা উৎসাহিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের কাছ থেকে হুমকি পাওয়া মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মানুষেরা।

“রাষ্ট্র যে একটা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রধর্মের বিধান রেখেছে, এটাও জঙ্গিদের উৎসাহিত করছে। কারণ তাদের বোঝানোই হয় তাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, অন্যরা হত্যাযোগ্য,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহিত্যের এই প্রবীণ শিক্ষক বেনামি এক মুঠোফোন বার্তায় ২০১৫ সালে নভেম্বরে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন।

“একদিকে জঙ্গিদের দমন, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু অপরদিকে ভোটের রাজনীতির খেলায় নানাভাবে এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে তোষণও করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন জঙ্গিদের হিটলিস্টে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসু।

বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর এই সাবেক সভাপতি আরও বলেন, “এ জাতীয় টার্গেট কিলিং বন্ধের জন্য অতীতের ঘটনাগুলোর বিচার করা প্রয়োজন। বিচার না হলে এ জাতীয় সন্ত্রাসীরা আরও উৎসাহিত হবে।”

তবে “রাষ্ট্রধর্মের সাথে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই” বলে মন্তব্য করেন কয়েক বছর ধরে জঙ্গিদের হিটলিস্টে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

তাঁর মতে “ইসলাম কেন, কোনো ধর্মই এ জাতীয় উস্কানীমূলক নৈরাজ্যকে সমর্থন করে না।”

“জঙ্গীবাদ একটি স্বতন্ত্র ধারা। যা ভাইরাসের মতো সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে,” বলেন তিনি।

“জঙ্গিরা এখন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হামলা করছে,” উল্লেখ করে ইনু বলেন “বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদকে কঠোর হস্তে দমন করার ফলে তা কাবু হয়েছে, পিছু হটেছে।”

তবে “আত্মসমর্পণ যেহেতু করেনি, সেহেতু বিপদটা এখনো আছে” স্বীকার করেন তিনি।

পুলিশ দিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব নয়

সম্প্রতি পুলিশের উপস্থিতিতে ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে শুধু নিরাপত্তা দিয়ে ‘টার্গেটেড কিলিং’ প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাঁদের মতে, উগ্রবাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে দরকার সামাজিক আন্দোলন, একই সঙ্গে দরকার এ জাতীয় হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার সুনিশ্চিত করা।

“জাফরের ঘটনার পরপরই আমার বাড়িতে প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে” উল্লেখ করে জঙ্গিবাদ “একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়” বলে মন্তব্য করেন আনিসুজ্জামান।

তিনি বলেন, “কেউ যদি সংকল্প করে যে সে নিজের জীবনের পরোয়া না করে একজনকে আক্রমণ করবে, তাহলে তাকে ঠেকানো খুব কঠিন হয়।”

তাঁর মতে, “কিশোর-তরুণদের ভ্রান্ত আদর্শের প্রতি টান বা আকর্ষণ, দেশে এ অবস্থার তৈরি করেছে।”

“কেবল নিরাপত্তা দিয়েই এসব হত্যা- বন্ধ করা সম্ভব না। জাফর ইকবালের ওপর হামলা সেটাই প্রমাণ করে,” বেনারকে বলেন জঙ্গিদের হিটলিস্টে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাকিল আহমেদ অরণ্য।

অরণ্যের অভিমত, “জঙ্গিবাদী ধারার বিপরীতে যে ধারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তা কেবল আমরা মুখে আওড়াই। ভোটের হিসেব কষতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নানাসময় মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের (ধর্মনিরপেক্ষ) চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলেই আজ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।”

তিনি বলেন, “পাঠ্যপুস্তকের যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটছে তা বন্ধ করতে হবে। মূল শিক্ষা ব্যবস্থা সেক্যুলার ও বিজ্ঞানভিত্তিক করতে হবে।”

“গত কয়েক বছরে যেসব ব্লগার, লেখক, এলজিবিটি অ্যাকটিভিস্ট, প্রকাশক ও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার দ্রুত বিচার করে কঠোর শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের এই সাবেক নেতা।

এ প্রসঙ্গে “প্রটেকশন থাকলেও অতর্কিত হামলা হতে পারে,” স্বীকার করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “জাফর স্যারের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো ওরা শেষ হয়ে যায়নি, শোধরায়নি।”

“অতএব এখন তাদের সমূলে ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শুধু জঙ্গিদের নয়, তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও ধরা দরকার,” যোগ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে নিউ মিডিয়া ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষক নির্ঝর মজুমদার বেনারকে তিনি বলেন, “২০১৩ সালে হুমকির তালিকায় নাম ওঠানো অনেকেই ২০১৫ সালে মারা গেছেন। তেমনি করে ২০১৫ সালে হুমকি পাওয়া জাফর ইকবাল স্যার ২০১৮-তে এসে হামলার শিকার হয়েছেন।”

“মোটিভেটেড জঙ্গিদের ঠেকানোর জন্য কোনো নিরাপত্তাই পর্যাপ্ত হবে না। কারণ এরা নিজেদের মৃত্যু কামনা করেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়,” দাবি করেন প্রবাসী এই গবেষক।

তিনি আরও বলেন, “এ ক্ষেত্রে একমাত্র করণীয় হলো—জঙ্গিদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি যারা তাদের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে উৎসাহিত করে তাদেরও সমান অপরাধী বিবেচনা করে শাস্তির আওতায় আনা।”

“এ ধরনের জঙ্গীবাদীরা যাতে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রণোদনা না পায় তা নিশ্চিত করাও জরুরি” যোগ করেন তিনি।

“আমি মনে করি সরকার যথেষ্ট করছে। যত দূর সম্ভব চেষ্টা করছে আমাদের রক্ষা করার,” মন্তব্য করলেও আনিসুজ্জামান বলেন, “সরকারের উচিত সামাজিকভাবে মৌলবাদীদের প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালানো।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।