সিলেটে পাঁচ দিন পর অভিযান সমাপ্ত, জঙ্গি নেতা মুসা নিহত

প্রাপ্তি রহমান
2017.03.28
ঢাকা
অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। ২৭ মার্চ ২০১৭।
সৌজন্যে: আইএসপিআর

সিলেটের ‘আতিয়া মহলে’ নিহত চার জঙ্গির মধ্যে একজন নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা রয়েছেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পু‌লিশ সদরদপ্ত‌রে কাউন্টার টেরর‌জি‌মের ফোকাল প‌য়েন্ট ম‌রিুজ্জামান জানান, “বা‌ড়ি ভাড়া নেওয়‌ার সময় মুসা যে ছ‌বি জমা দি‌য়ে‌ছি‌ল, সে ছ‌বি এবং আমা‌দের কা‌ছে থাকা ছ‌বি‌টি একই। তারপরও তার ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হ‌য়ে‌ছে।”

মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা তামীম চৌধুরীর অন্যতম সহযোগী। তানভীর কাদেরি, মেজর (অব) জাহিদুলের মৃত্যু ও বাশারুজ্জামান চকলেট গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকায় তিনিই সংগঠন গোছানোর কাজ করছিলেন বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

গত বছরের ১ জুলাই গুলশা‌নের হ‌লি আর্টিজা‌ন থে‌কে গতকাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বা‌হিনীর অভিযানে ৫৩ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে।

অভিযানে নিহত বাকি তিনজনের পরিচয় মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। সকালে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে চারজনেরই ময়নাতদন্ত হয়। সংরক্ষণ করা হয়েছে শরীরের নমুনাও।

মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। ফাইল ছবি।
মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। ফাইল ছবি।
[স্টার মেইল]
গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ‘আতিয়া মহল’ এ অপারেশন টোয়ালাইটের সমাপ্তি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। রাতেই ভবনটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে তাঁরা। এখন পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত করার ও পুলিশের বিশেষ শাখা অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করবে।

বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে সিলেটের আতিয়া মহল ঘেরাও করে সিলেট মহানগর পুলিশ ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘ এই অভিযান শুরুর ৯০ ঘণ্টার মাথায় এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান জানান, আতিয়া মহলের ভেতরে আর কোনো জঙ্গি জীবিত নেই। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ওই ভবনে যারা ছিল তাঁরা প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিলেন।

যেভাবে শেষ হলো ‘অপারেশন টোয়ালাইট’

শনিবার থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান প্রতিদিন সাংবাদিকদের অভিযান সম্পর্কে অবহিত করেন। বৃহস্পতিবার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত ভবনটি জঙ্গিমুক্ত করতে পারেনি কমান্ডোরা। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, মানুষের জীবন বাঁচানো ছিল প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।

পুলিশ ও সেনাসদস্যরা জানান, প্রচুর বেসামরিক লোকজন থাকায় তাঁদের উদ্ধার অভিযানের কৌশল নির্ধারণে দেরি হয়। এছাড়া শনিবার সংবাদ সম্মেলনস্থলে বোমা বিস্ফোরণে পুলিশের দুই সদস্যসহ ছয়জন নিহত হওয়ায় সতর্কতার সঙ্গে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেন “এখানে যারা ছিল তারা মোটামুটি বেশ ওয়েল ট্রেইনড।”

জঙ্গি দমনে সেনাবাহিনীর অনুসরণ করা প্রক্রিয়া সম্পর্কে ফখরুল আহসান বলেন, “কমান্ডোরা রকেট লাঞ্চারের মাধ্যমে গর্ত তৈরি করেছেন, বিস্ফোরক ব্যবহার করলেও তা কার্যকর হয়নি। পরে তাঁরা ভেতরে কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করেন। তখন জঙ্গিদের পক্ষে সেখানে থাকা কঠিন হয়ে যায়। ভবনের ওপর থেকে নিচে নামার সময় কমান্ডোরা দুজনকে গুলি করেন। এতে তাঁরা পড়ে যায়। তাঁদের একজন ওই অবস্থায় শরীরে বেঁধে রাখা বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটান।”

উদ্ধার করা চারটি মৃতদেহই পুড়ে গেছে, শরীরের বিভিন্ন অংশ বিস্ফোরণে উড়ে গেছে।

সেনাবাহিনী সূত্রে জানা যায়, জঙ্গিরা পুরো বিল্ডিং এ নিচ থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আইইডি স্থাপন করে। তাদের কাছে ছোট অস্ত্র, গ্রেনেড ছিল। প্রত্যেক সুইসাইডাল ভেস্ট পরেছিল। তারা কমান্ডোদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে, কমান্ডোদের ছোড়া গ্রেনেড পাল্টা ছুড়ে মেরেছে, বোমা ফাটিয়েছে। ভবনটিতে যে পরিমাণ বিস্ফোরক আছে সেগুলো ফাটলে ভবনের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পুরো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে।

আতিয়া মহল থেকে জিম্মি থাকা ৭৮জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করাকে অভিযানের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে উল্লেখ করেন ফখরুল আহসান। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই কমান্ডোরা ভবনটির পেছন দিক থেকে গিয়ে মই লাগিয়ে, গ্রিল কেটে বাসিন্দাদের একজন একজন করে বের করে আনে বলে জানান তিনি।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল মান্নান অভিযানটি কাছ থেকে দেখেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “জঙ্গিরা আশা করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে আত্মঘাতী হবে। আমাদের কাছে তথ্য ছিল মূল ফটকের সামনে তারা একটি বোমা, তার সামনে পেট্রলে ভরা একটি মোটরসাইকেল রেখেছে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হলে বোমা বিস্ফোরণ করত, তাতে পুরো ভবনটি উড়ে যেত। আর সে কারণেই পেছন থেকে ঢোকার চেষ্টা হয়।”

জিম্মিদশা থেকে বেরিয়ে স্বস্তি ভবনের বাসিন্দাদের

জিম্মি দশা থেকে বেরিয়ে ভবনের বাসিন্দারা বলেন, তাঁরা নতুন জীবন পেয়েছেন। ওই ভবনের বাসিন্দা উজ্জ্বল চক্রবর্তী ও কান্তা ভট্টাচার্য। তাঁরা ২৫–৩০ ঘণ্টা ওয়াশ রুমে আটকা পড়েছিলেন। উজ্জ্বল স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন, বোমা আর গুলির শব্দে একবার মনে হয়েছিল তাঁরা বাঁচবেন না।

এরপর শনিবার সকালে ভবন মালিক উস্তার আলীর মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দরজায় কড়া নাড়লে নিঃশব্দে দরজা খোলার নির্দেশ দেন। বলা হয় খালি পায়ে দুই হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসতে।

“যখন সেনাবাহিনীর সদস্যদের দরজায় দেখি, তখন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম,”, উজ্জ্বল বলেন।

বৃহস্পতিবার রাত থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এমনকি বাজার না বসায় অভিযানস্থলের চারপাশে মানুষ মারাত্মক কষ্টে পড়েন। জঙ্গিমুক্ত হওয়ায় তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।

সতর্ক অবস্থায় পুলিশ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে অভিযান চালিয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য। তবে, সামগ্রিক পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক।”

তবে জঙ্গিরা আস্তানা গাড়লেও শেষমেশ পুলিশই সেটা খুঁজে বের করছে- এমন দাবি করেছে আইনশৃ্ঙখলা বাহিনী।

পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে হামলা করার চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে কোনো হামলা চালানোর ক্ষমতা আর তাদের নেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।