হলি আর্টিজান সংক্রান্ত সব অভিযোগ থেকে মুক্ত তাহমিদ
2017.04.17
ঢাকা

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনা তদন্তে পুলিশকে সহযোগিতা না করার মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তাহমিদ হাসিব খান। গত রোববার তাহমিদের উপস্থিতিতে ঢাকার মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসান এই রায় ঘোষণা করেন।
এর মধ্য দিয়ে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় তাহমিদের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত হলেন কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র।
এ প্রসঙ্গে তাহমিদের আইনজীবী মো. মাসুদ আরিফ ভুইয়া বেনারকে বলেন, “তাহমিদ এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। বাংলাদেশের যেকোনো সাধারণ নাগরিকের মতোই ফ্রি, চলাফেরায় কোনো বাধা-নিষেধ নেই। হলি আর্টিজান সংক্রান্ত কোনো কিছুতে তাঁর বিরুদ্ধে আর অভিযোগ রইল না।”
“চাইলে যেকোনো সাধারণ নাগরিকদের মতো বিদেশেও যেতে পারবেন তাহমিদ,” বলেন তাঁর আইনজীবী।
অ্যাডভোকেট মাসুদ বলেন, “তথ্য গোপনের যে অভিযোগ তাহমিদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, তা প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত মামলাটি থেকে তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।”
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে জিম্মি করার পরে ১৮ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের ছোড়া বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পরদিন সকালে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হন।
ওই বেকারি থেকে ৩২ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাহমিদ হাসিব খান এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম উদ্ধার হওয়াদের মধ্যেই ছিলেন।
উদ্ধার হওয়া সবাইকে ছেড়ে দিলেও তাহমিদ ও হাসনাত বাসায় ফেরেননি বলে সেসময় তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এর প্রায় মাস খানেক পর ৩ আগস্ট ওই দুজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার মামলায় ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ।
হামলার পরপরই জঙ্গিদের সঙ্গে তাহমিদের কিছু ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তৈরি হয়। তবে ১৪ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর গুলশান হামলার ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানায় পুলিশ।
গত বছরের ৩ অক্টোবর তাহমিদকে ৫৪ ধারার সেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত। এতে তিনি মুক্তি পেলেও সেদিনই তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৭৬ ধারায় তদন্তকাজে কোনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা না করার অভিযোগ এনে নতুন মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় জামিনে ছিলেন তাহমিদ। রোববার সে মামলা থেকেও খালাস পেলেন তিনি।
হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনায় করা মামলা থেকে তাহমিদ খালাস পেলেও গ্রেপ্তার দেখানো হয় হাসনাত রেজা করিমকে। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
গত মার্চের শুরুতে এক প্রশ্নের জবাবে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, হাসনাত করিম ছাড়াও হলি আর্টিজানের ঘটনায় বর্তমানে কারাগারে আছেন আরো তিনজন। তারা হলো বড় মিজান, জাহাঙ্গীর ও রাজীব গান্ধী।
তাহমিদের বিষয়ে জানতে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তাঁর বাবা আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার ছেলের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
তবে তাহমিদের আইনজীবী মাসুদ আরিফ বেনারকে বলেন, “মামলা কাজে তাহমিদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি এখন বেশ ভালো আছেন।”
“তবে অত বড় একটি ঘটনার (হলি আর্টিজানে হামলা) মানসিক ট্রমা কাটাতে অনেক দিন তাঁর চিকিৎসা করাতে হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাহমিদের একজন আত্মীয় বেনারকে বলেন, “গুলশান হামলার একদিন আগে দেশে ফেরা তাহমিদ সেদিন সন্ধ্যার পরে বন্ধুদের সঙ্গে হলি আর্টিজানে গিয়েছিল নিছক আড্ডা দিতে। কিন্তু সেটাই কাল হলো। নিরপরাধ ছেলেটিকে দিনের পর দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এতে করে শুধু তাহমিদ নয় পুরো পরিবার একটা ট্রমার মধ্যে ছিল।”
তবে তাহমিদ আবার পড়ালেখা করতে কানাডায় ফিরবেন নাকি দেশে থাকবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি তিনি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, তাহমিদের মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়-দেশে জঙ্গি দমনের নামে কিছু নিরপরাধ মানুষও ভুক্তভোগী হচ্ছে। বিনা অপরাধে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকাসহ মানসিক নিপীড়ন সহ্য করার জন্য তাহমিদ ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন বলেও মত তাঁদের।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম হাসান তালুকদার বেনারকে বলেন, “কোনো দোষ না করেও তাহমিদের পুলিশি হেফাজত কিংবা কারাগারে থাকাটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। তাকে আটক করাটা ভুল ছিল বুঝতে পারলে রাষ্ট্রেরই উচিত তাহমিদকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।”
তিনি বলেন, এ ঘটনা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে কিছু নিরপরাধ মানুষও ভিকটিম হচ্ছে। ভুল হতেই পারে। কিন্তু তা ইচ্ছাকৃত না হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শাস্তি পাবেন না, তবে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যদি প্রমাণিত হয়, কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন, তাহলে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ওই কর্মকর্তাকেও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”
নিম্ন আদালতের দেওয়া তাহমিদের খালাসের রায় চূড়ান্ত নয় বলেও জানান এই আইনের অধ্যাপক। তাঁর মতে, রাষ্ট্রপক্ষ যদি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপিল না করে, তাহলে ধরে নেওয়া যাবে তারা এই রায় মেনে নিয়েছে। তখনই তাহমিদকে পুরোপুরি মুক্ত বলা যাবে।