পুলিশের ওপর ককটেল হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.04.30
ঢাকা
190430_IS_story_1000.JPG ঢাকার মোহাম্মদপুর সংলগ্ন বছিলা এলাকায় অভিযানের সময় জঙ্গি আস্তানা ঘিরে র‍্যাবের পাহারা। ২৯ এপ্রিল ২০১৯।
[রয়টার্স]

ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে পুলিশের ওপর চালানো ককটেল হামলার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এ কথা জানিয়েছে অনলাইনে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ।

সোমবার রাতে চালানো হামলায় তিন ট্রাফিক পুলিশ আহত হয়েছেন।

দুই বছর পর বাংলাদেশে কোনো হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিলো আইএস। এর আগে ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশ চেকপোস্টের কাছে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকার করে আইএস।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালানো ও নিহত পাঁচ জঙ্গির ছবি এবং ইসলামিক স্টেটের লোগো সংবলিত বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা একটি নতুন বার্তা প্রকাশ করেছে আল মুরসালাত মিডিয়া।

আল মুরসালাত ইসলামিক স্টেটের একটি মিডিয়া ইউনিট বলে মঙ্গলবার বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ। বার্তাটি আবু মুহাম্মাদ আল বাঙালীর নামে প্রচারিত।

ওই বার্তায় বলা হয়েছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দমিয়ে দিয়েছে ভাবলেও তারা দমে যায়নি এবং তাদের প্রতিশোধের ভাবনাও শেষ হয়ে যায়নি। তাদের রাগ ও ক্ষোভ বিপর্যয় ডেকে আনবে।

তবে এই বার্তাটিকে ‘প্রপাগান্ডা’ হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে “তারা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না,” বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

“আমরা পোস্টারটি সম্পর্কে জেনেছি। এগুলো কিছু না। প্রপাগান্ডা,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমরা জঙ্গিদের শক্ত হাতে দমন করেছি। তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছি। এগুলো তাদের হাঁকডাক ছাড়া আর কিছু না। আমরা সজাগ আছি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সক্ষম। তারা বাংলাদেশে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ দেশের মানুষদের মাঝে জঙ্গিদের কোনো স্থান নেই।”

এদিকে সোমবার সকালে বছিলায় দুই জঙ্গির আত্মঘাতী হওয়া এবং রাতে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাকে পুনরায় জঙ্গি উত্থানের লক্ষণ বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, সোমবারের ওই ককটেল দেশীয় অন্যান্যগুলোর চাইতে আলাদা ও শক্তিশালী। তিনি বলেন, এই হামলার সাথে আইএস’র সংশ্লিষ্টতা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

পুলিশের ওপর হামলা

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, সোমবার রাত আনুমানিক নয়টার দিকে গুলিস্তান মোড়ে ডিভাইডারের কাছে অবস্থিত পুলিশ বক্সের কাছে কর্তব্যরত তিন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করা হয়।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালিয়ে যায় আক্রমণকারীরা। আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন, নজরুল ইসলাম (৪৫), মো. লিটন (৪২) এবং কমিউনিটি পুলিশ সদস্য মো. আশিক (২৮)।

মোজাম্মেল নামের এক হকার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “রাতে আমরা দোকান বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই হঠাৎ বিকট শব্দ। আমরা সবাই যে যেখানে পারি লুকিয়েছি। পুলিশরা চিৎকার করে সাহায্য চাচ্ছিল।”

তিনি বলেন, পরে আহত পুলিশ সদস্যদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।

মোজাম্মেল বলেন, তিনি আক্রমণকারীদের দেখতে পাননি।

সোমবার রাতেই আইএস’র দায় স্বীকারের বিষয়টি জানায় সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ।

মঙ্গলবার সকালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে হাসপাতালে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আক্রমণকারী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আইএস’র দায় স্বীকারের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কমিশনার বলেন, “আইএস বা অন্য কেউ প্রতারণামূলক এ ধরনের পোস্ট দিয়েছে কি না আমাদের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অ্যান্টি টেররিজম বিশেষজ্ঞরা তা পরীক্ষা করে দেখছেন।”

তিনি আরও বলেন, “বিস্ফোরণ হওয়া ককটেলটি সাধারণ ককটেল থেকে ভিন্ন রকম ছিল। কাউন্টার টেররিজম বিস্ফোরণের ধরনসহ প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছে।”

আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “ঘটনাটি আদৌ জঙ্গি-সংশ্লিষ্ট কি না, নাকি সাধারণ অপরাধীরা এটি করেছে, নাকি তৃতীয় কোনো মহল এটি করতে পারে, বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। ঘটনার পর ট্রাফিক পুলিশের নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজ চলছে।”

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “আইএস আক্রমণ করেছে কি না সেটি বড় ব্যাপার নয়। তবে সোমবার দুটি আক্রমণের ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে আবার জঙ্গিরা মাথা চাড়া দিচ্ছে।”

তিনি বলেন, “গুলিস্তানের ককটেল বিস্ফোরণের মতো আক্রমণ সাধারণত করে না আইএস। কিন্তু ইরাক-সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আইএস জঙ্গিরা হয়তো তাদের আক্রমণের মডিউল পরিবর্তন করেছে।”

“আইএস ভূমি হারিয়েছে সেটা ঠিক। কিন্তু ভূমি হারালেই যে আক্রমণ বন্ধ থাকবে তার কোনো মানে নেই,” মন্তব্য করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “তাদের আদর্শ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। নব্য জেএমবি আইএস আদর্শে বিশ্বাসী।”

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের পর এর দায়দায়িত্ব আইএস স্বীকার করে বলে জানায় সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। তাবেলা হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোসিকে হত্যা করে জঙ্গিরা।

এরপর থেকে সারাদেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। এবং প্রত্যেকটি ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে বিবৃতি দেয় আইএস।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আইএস’র উপস্থিতি নাকচ করে জানানো হয়, হামলাকারীরা দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠী নব্য জেএমবি’র সদস্য।

২০১৬ সালের পয়লা জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে নৃশংস হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে সেখানকার ২০ অতিথিকে হত্যা করে জঙ্গিরা। নিহতদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি।

পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হবার আগে রাতেই আইএস দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে হামলাকারীদের পরিচয় প্রকাশ করে।

পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের নব্য জেএমবি সদস্য বলে জানানো হয়।

হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার পর বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে শতাধিক জঙ্গি নিহত হয়।

সর্বশেষ সোমবার ভোরে রাজধানীর বছিলায় র‍্যাব এক জঙ্গি ঘাঁটি ঘিরে ফেললে সেখানকার দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি আত্মঘাতী হয়।

মামলা করেছে র‌্যাব

মঙ্গলবার ঢাকার বছিলায় দুই জঙ্গির ‘আত্মঘাতী’ হামলার ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, মামলায় পাঁচ-ছয়জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা এখনো পর্যন্ত আত্মঘাতী দুই জঙ্গির পরিচয় জানতে পারিনি। আমাদের ফরেনসিক দল এব্যাপারে কাজ করছে। তাদের ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”

মিজানুর বলেন, “আমরা বাড়ির কেয়ারটেকার ও বাড়ির মালিককে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তবে তাদের আসামি করা হয়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।